Wednesday, 31 August 2016

নদীয়া জেলার তপসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: একটি কেস স্টাডি

নদীয়া জেলার তপসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণঃ 

একটি কেস স্টাডি


মনোজ কুমার হালদার
সহকারী অধ্যাপক, রাষট্রবিজ্ঞান বিভাগ, 
নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

--------------------------------------------------------------------------------------------------

         


  গণতন্ত্র শব্দটির ইংরাজী প্রতিশব্দ Democracy। এই Democracy শব্দটির উৎপত্তি দুটি গ্রীক শব্দ `Demos’ এবং `Kratos’ থেকে। `Kratos’ শব্দটির অর্থ জনগণ এবং  `Kratos' শব্দটির অর্থ শাসন অর্থাৎ গণতন্ত্র শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল জনগণের শাসন এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কনের পরিভাষায়, গণতন্ত্র হল জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা জনগণের শাসনব্যবস্থা। পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা, জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, গণতন্ত্রে সত্যিই কি সমাজের প্রতিটি অংশের মানুষের দ্বারা সরকার নির্বাচিত হয়? বা সরকার নির্বাচনে প্রত্যেকের সুযোগ থাকে? গণতান্ত্রিক সরকার কি সত্যিই জনগণের প্রতিটি অংশের জন্য কাজ করে? এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি উল্লেখের দাবী করে। ‘নারী’ এক ব্যাপক বর্গনাম হিসাবে দেখলে অবশ্যই ভারতীয় সমাজে নারীরা এখনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সেভাবে করতে পারে নি, পুরুষদের তুলনায় নারী অনেক পিছিয়ে। আবার নারী বর্গ পরিচয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসর যেমন, জাত, ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণী, পেশা, গ্রাম-শহর ভেদে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার সাধারণ নারী বর্গের তুলনায় ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে তপসিলি জাতি, উপজাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, গ্রামীণ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের নারী শ্রমিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার খুবই কম। সত্যিকারের গণতন্ত্রে এই বিশাল বর্গের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ভীষণ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ।
          একথা সর্বজন বিদিত, নারীরা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে তেমনি রাজনীতির অঙ্গনে সমানভাবে পশ্চাদ্পদ। এই ঐতিহ্য প্রাচীন কাল থেকে নারী বহন করে চলেছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। যদিও ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও সংবিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে নারীদের জন্য কিছু সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা স্বীকৃত হয়েছে। আইনের চোখে নারী- পুরুষ সমান, সমান সুযোগ সুবিধা গ্রহণের অধিকারী। কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বটে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে- সংবিধান বা আইন করে নারীদের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার দিলেই হয় না তা গ্রহণের সক্ষমতা সবার আগে প্রয়োজন। সেই সুযোগের অভাবেই নারী তার জন্য ধার্য অধিকার, স্বাধীনতা ভোগে অপারগ, অক্ষম। এবং সমানভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী একইরকম ভাবে পিছিয়ে। নারীর মধ্যে আবার তপসিলি জাতি, উপজাতি নারীরা অবহেলিত পিছিয়ে পড়া নারীদের মধ্যেই আবার সবচেয়ে পিছিয়ে। এখানেই একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, এই পিছিয়ে পড়া তপসিলি জাতির মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনা কেমন? তাদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার কিরূপ? তারা কেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করে?
          তবে এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কাকে বলে তা বলা দরকার। রাজনেতিক অংশগ্রহণকে যেখানে গণতন্ত্রে একটি মৌল শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। লুসিয়ান পাই সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়াকে পরিব্যপ্ত করাকেই রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলেছেন। হারবার্ট ম্যাক্ক্লস্কি-র মতানুসারে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে সমাজের সদস্যদের বিশেষ কিছু স্বেচ্ছামূলক কাজকর্মকে বোঝায়। এই সমস্ত কাজকর্মের মাধ্যমে শাসকদের বাছাই করা এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তারা অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কাজকর্মের কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ভোটদান, রাজনৈতিক দলের সমর্থনে আর্থিক সাহায্যপ্রদান, ধর্মঘট ও ধর্ণায় অংশগ্রহণ, মিটিং-মিছিলে যোগদান, আইনসভার সদস্য ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সঙ্গে সংযোগ সাধন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, আবার অধিকতর সক্রিয় প্রকৃতিরও হয় যেমন দলের সদস্যপদ গ্রহণ, দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচার কাজে অংশগ্রহণ, নির্বাচনী মিটিং মিছিলে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ, সরকারী ও দলীয় পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হওয়া প্রভৃতি। আবার এই সমস্ত কাজকর্মের বিপরীত ধারাকে বলা যায় উদাসীনতা বা নির্লিপ্ততা। অ্যালমন্ড ও পাওয়েলÑ এর মতে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমাজের সদস্যদের সংযুক্ত থাকার বিষয়টিই হল রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। তবে অনেক রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী বাস্তব রাজনৈতিক আচরণ ছাড়াও রাজনৈতিক অংশগ্রহণমূলক পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্ক বা মনোভাবকেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি পরোক্ষ যোগাযোগকেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলা যায়।
          আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতি শুধু পুরুষদের এক্তিয়ার, মহিলারা সেখানে এখনো ব্রাত্য। পরিসংখ্যান সেকথাই বলে। আমাদের জাতীয় আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষ লোকসভায় আজ পর্যন্ত ১৩% নীচে মহিলা প্রতিনিধি নির্বাচিত থেকে গেছে। রাজ্য আইন সভাগুলিতেও নারীর অংশগ্রহণ প্রায় অনুরূপ। আসলে ভারতীয় নারী শুধু রাজনীতিতে নয় সমাজের সকল ক্ষেত্রেই, কি অর্থনৈতিক, কি সাংস্কৃতিক বা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে। তার প্রতিফলন অবশ্যই রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও নারী তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় নারীকে সেভাবে গড়ে তোলেনি। রাজনীতি বাইরের বিষয়, বড় বিষয়, নারীতো অন্তপুরবাসিনী, সংকীর্ণ গণ্ডিতে সে সীমাবদ্ধ। গণতান্ত্রিক শাসন, আইনের অধীন সেও, কিন্তু আইন রচনায় তার কোন ভূমিকা নেই। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রেও এক রূপ।
          তবে আশার কথা ভারতীয় সংবিধানে যে মৌল নীতি ঘোষিত হয়েছে তার মূলকথা- সাম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্যরোধ, সমাজের সকল ক্ষেত্রে। সংবিধান তথা আইনগত সাম্য ও অধিকার আজ স্বীকৃত। বর্তমানে নারীর রাজনৈতিক অধিকার তথা অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে সরকারীস্তরে  সক্রিয় পদক্ষেপ লক্ষ্যণীয়। ১৯৯৩ সালে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেখানে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদেও এক তৃতীয়াংশ অংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়েছিল আজ তা ক্রমবর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইনে মহিলাদের জন্য ৫০% আসনও সংরক্ষিত হয়েছে যাতে আনুপাতিক হারে তপসিলি জাতি উপজাতির মহিলাদের আসনও সংরক্ষিত। তবে গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদের নির্বাচন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৭৩ তম সংবিধান সংশোধন আইনের প্রয়োগ দু’দশক অতিক্রান্ত। এখন সময় এই দু’দশকে নারী কতটা রাজনৈতিক সচেতন হল? তাদেরও অংশগ্রহণের প্রকৃতিই বা কেমন? এই প্রেক্ষিতেই নদীয়া জেলার তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রকৃতি অনুধাবনের লক্ষ্যে নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার ক্ষেত্রসমীক্ষায় যে বিষয়গুলি উঠে  এসেছে সেগুলি হল নিম্নরূপ।
          নদীয়া জেলার জনবিন্যাসে তপসিলি জাতিভুক্ত মানুষের  সংখ্যা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ; সুতরাং এই সম্প্রদায়ের মানুষের মতামত নদীয়া জেলা তথা রাজ্যের রাজনীতিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করবে একথা বলাই যায়। এই ৩০ শতাংশ মানুষের মোটামুটি অর্ধেক নারী, তাদের মতামত, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্রসমীক্ষার এলাকা নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমা, যার অধীনে চারটি ব্লক যথাক্রমে করিমপুর-১, করিমপুরÑ২, তেহট্টÑ১ ও তেহট্টÑ২্ এই চারটি ব্লক থেকে দুটি করে পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে মোট ৬ টি পঞ্চায়েত এলাকা থেকে ১০ জন করে তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলা ভোটার বেছে নেওয়া হয় র‌্যান্ডাম স্যাম্পলিং নীতির ভিত্তিতে। তাদের সাথে সাক্ষাৎকার ও কিছু তালিকাবদ্ধ প্রশ্নের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে যে বিষয়গুলি উঠে আসে সেগুলি হল নিম্নরূপ:
          সমীক্ষায় স্যাম্পেল হিসাবে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদের মধ্যে ৫৯% হল ১৮- ৩০ বছর বয়েসী, ৩৩% হল ৩১-৫০ বছর বয়সী এবং মাত্র ০৮% ৫০ বছরের উর্দ্ধে। ৮১% বিবাহিত, ১২% বিধবা এবং মাত্র ০৬% অবিবাহিতা। ৬২% পরিবারের মাসিক আয় ৪Ñ৫ হাজার টাকার মধ্যে।
          তাদের ৬৭% অষ্টম মান বা তার নীচুমান পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেছে। ২৩% মাধ্যমিক, ১৬% উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং ২৪% অক্ষর জ্ঞান বর্জিত। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৭২% গৃহবধূ,  যাদের কোন অর্থকরী পেশা নেই, ২% সরকারী চাকুরীরতা, ৩% ছোট ব্যবসায় যুক্ত এবং ২৩ শতাংশ ক্ষুদ্র কুটীর ও হস্ত শিল্পে নিযুক্ত।
          সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা চোখে পড়ার মত সেটি হল, খুব সামান্য অংশই রাজ্য, জাতীয় বা স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত উত্তরদাতাদের খুব ক্ষুদ্র অংশ সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত। ৮৬% উত্তরদাতা রাাজনেতিক বিষয়ে পরিবার প্রধানের উপর নির্ভরশীল বলে জানান।
          সমীক্ষার সময়ে প্রশ্ন্-উত্তর ও উত্তরদাতাদের সাথে কথা বলে যে বিষয়গুলি উঠে আসে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই বিবাহিত এবং সেকারণে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হয়নি, ফলত: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি পুরুষ পরিবার প্রধানের অধীন। এবং পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল সে কারণে পরিবারের মহিলারা কিছু হস্তশিল্প ও কুটীর শিল্পের সাথে এবং কৃষি শ্রমিকের  কাজে যুক্ত। তাদের অধিকাংশকেই পরিবারের শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের দেখভাল, প্রাত্যহিক গৃহকর্ম ও গৃহপালিত পশুপাখিদের পরিচর্যা করতে হয় এসবের পর তাদের আর বাইরের জগৎ ‘রাজনীতি’ বিষয়ে আগ্রহ থাকে না বলে জানান।
          একথা ঠিক, সমগ্র দেশ, রাজ্য বা জেলার সাথে এই মহকুমার ঘটনা কোন ব্যাতিক্রম নয়। তপসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ অর্থনৈতিক অবস্থায় ও সামাজিক অবস্থানে পিছিয়ে তার প্রতিফলন রাজনৈতিক অংশগ্রহণে প্রতিফলিত হয়। তবে আশার কথা নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার হার ক্রমবর্ধমান, ফল হিসাবে তারা সচেতনতায় আধুনিক চিন্তাধারায় প্রবীণদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বর্তমান প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে প্রবীণদের তুলনায় আগ্রহী ও সচেতন। বিগত দুই দশকে গ্রামীণ স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদের আসন সংরক্ষণের সুবাদে তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলারা তুলনামূলক বিচারে বর্তমানে অনেকাংশে রাজনীতি সচেতন হয়েছেন।