Monday, 30 November 2015

নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন - সুভাষ বিশ্বাস

প্রকল্পের বিষয় : নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন
- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

১৯৪৭-পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা -সুভাষ বিশ্বাস

১৯৪৭-পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা

-সুভাষ বিশ্বাস

Sunday, 29 November 2015

স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ - সুভাষ বিশ্বাস



স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ

- ড. সুভাষ বিশ্বাস
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়



ভূমিকা:
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত বিভাজিত হয়ে পৃথক পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। ভারত বিভাগের সূত্রে বাংলাও দ্বিখ-িত হয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় সেদিন মহম্মদ আলি জিন্নাকে মুসলিম জাতির একমাত্র ত্রাতা ও রক্ষাকর্তা মনে করে তাদের মন-প্রাণ জিন্নার জন্য উসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তারা জিন্নাকে তাদের ‘জাতির পিতা’ হিসাবে স্বীকার করে সেদিন আনন্দে উল্লসিত হয়ে স্লোগান তুলেছিলেন “এক জাাতি মুসলমান, এক রাষ্ট্র পাকিস্তান, এক নেতা কয়েদ এ আজম (জিন্না)।” পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা সেদিন স্বপ্নে বিভোর ছিলেন যে, পৃথক পাকিস্তান সৃষ্টি হলে মুসলিমরা হিন্দুদের অধীনতা থেকে মুক্তি পাবে, মুসলিমদের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিরাপদ হবে, দারিদ্রের অবসান হবে, চালের দাম কমবে ইত্যাদি।  কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর ৩/৪ বছরের মধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা অর্থা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় পশ্চিম-পাকিস্তান-বিরোধী মুক্তিযুদ্ধ।


স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুতীব্র আন্দোলনের ফলে পূর্ববঙ্গ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট হিসেবে বিভিন্ন ঘটনা কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন-

  ১. অর্থনৈতিক শোষণ: 
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ শুরু করে। স্বাধীনতা লাভের পর পূর্ববঙ্গের মানুষ শীঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়। মোট জাতীয় আয়ের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ থাকত। সরকার পূর্ববঙ্গকে শুধু কৃষি উপাদক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলে পূর্ববঙ্গকে পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করে। পূর্ববঙ্গে শিল্পায়ন না ঘটিয়ে সরকার এখানকার কৃষিপণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পের প্রসার ঘটায়।

  ২. রাজনৈতিক বঞ্চনা: 
অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের তীব্র রাজনৈতিক বঞ্চনার শিকার হয়। দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম পাকিস্তানে সীমাবদ্ধ ছিল। পশ্চিমের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও দেশের যাবতীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। পূর্ব পাকিস্তানের কোনো নেতা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনো না কোনো অজুহাতে তাঁদের পদচ্যুত করা হত। খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, হোসেন শহীদ শোরাবর্দী প্রমুখকে এভাবেই পদচ্যুত হতে হয়।

  ৩. বাঙালি জাতিসত্তা: 
দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হলেও পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতিসত্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের অ-বাংলাভাষী মুসলিমদের সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মুসলিম সংস্কৃতি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ঐতিহাসিক রফিউদ্দিন আহমেদ বলেছেন যে, পূর্ববঙ্গে ধর্মীয় দিক থেকে ইসলামীয় সত্তা বিরাজ করলেও জাতিগত দিক থেকে এখানে বাঙালি জাতিসত্তা অধিক গুরুত্ব পেত। এর ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিন পরই পূর্ববঙ্গের বাঙালি জাতিসত্তা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি জানায়।

  ৪. রাষ্ট্রভাষা উর্দু: 
স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮.১৬ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। আর পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনসংখ্যার ৫৬.৪০ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলত। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের আদম সুমারি রিপোর্টে দেখা যায় যে, সমগ্র পাকিস্তানের মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষ এবং পূর্ব পাকিস্তানের ১ শতাংশেরও কম সংখ্যক মানুষ উর্দুভাষী ছিল।  তা সত্ত্বেও পাক সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীদের উপর জোর করে এই ভাষা চাপিয়ে দেয়। পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনও মনে করতেন যে, সংস্কৃত ভাষা থেকে সৃষ্ট বাংলা হল হিন্দুদের ভাষা। তাই বাংলা কখনো মুসলিমদের ভাষা হওয়া উচিত হয়। জিন্নাও ঘোষণা করেন যে, ‘যারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার বিরোধিতা করে তারা পাকিস্তানের শত্রু।’

  ৫. বাঙালিদের ক্ষোভ:
পাক সরকার পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মানুষের উপর অনৈতিকভাবে উর্দুভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাংলাভাষাকে লুপ্ত করার কু চক্রান্তে নেমে পড়ে। মুষ্টিমেয় উর্দুভাষীয় অবাঙালিও পূর্ববঙ্গে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। কলকাতার জনৈক মন্ত্রী তখন বাংলা ভাষার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করলে তারা প্রকাশ্যে এই মন্ত্রীর ফাঁসি দাবি করে। এভাবে পাক সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলে পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাংলা ভাষাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে তারা পাক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়।

  ৬. ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন: নাজিমুদ্দিনের উদ্যোগ:
নাজিমুদ্দিন ইতিমধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গে উর্দুভাষার প্রসারে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে জানুয়ারি ঢাকায় এসে জানান যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং সরকারী তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে ২১টি কেন্দ্রে আরবী অক্ষরে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দান করা শুরু হয়েছে যা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে। নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ধর্মঘট শুরু হয়।  পুলিশের গুলি ঃ আন্দোলনকারী ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে ২১শে ফেব্রুয়ারি মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলে। ছাত্রদের সঙ্গে পুলিশের সংর্ঘষ বেধে গেলে পুলিশ নিরস্ত্র মিছিলে গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত ও রফিকুদ্দিন আহমেদের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাদের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ বাঙালি জাতি যে পাক-বিরোধী সংগ্রাম শুরু করে তা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য বাঙালিদের এই আন্দোলন ও আত্মত্যাগের ঘটনা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

  ৭. সংস্কৃতির প্রসার:
১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে বহু গান, কবিতা ও সাহিত্য রচিত হয়। এগুলি বাংলার প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লে গ্রামবাংলার মানুষ শিহরিত হয় এবং বর্বর পাক সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বর্ষণ করে। ২১শে ফ্রেব্রুয়ারির প্রেক্ষাপটে রচিত “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?” গানটি পূর্ববঙ্গের বাঙালির জনমানসে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলার কবি -------- লিখেছেন, “আমি চিকার করে উঠলাম, ‘পলাশ! পলাশ! ব্যর্থ হলো তোমার রং। এর চেয়েও আমার ভাইদের রক্ত লাল! বুকের রক্তে যারা পথ রাঙিয়ে দিলো।” ২১শে ফেব্রুয়ারির পাক সরকারের নারকীয় হত্যাকা- সম্পর্কে লেখা কবির ভাষা পরবর্তী দিনগুলিতে পাক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালি জাতিকে উদ্বুদ্ধ করলÑ
“আজকের দিন প্রমাণ দিয়েছে আমরা লড়তে পারি
আজকে মোদের শপথের দিন: ২১শে ফেব্রুয়ারি।”

  ৮. আওয়ামী লীগের ভূমিকা:
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আওয়ামী লীগ কয়েকটি ক্ষুদ্র দলের সঙ্গে মিলিত হয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানায়। যুক্তফ্রন্ট পূর্ববঙ্গের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করলেও পাক সরকার তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবর রহমান আন্দোলন শুরু করলে মুজিব-সহ লীগের প্রধান কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে তাদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু ব্যাপক গণ-আন্দোলনের চাপে সরকার ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে মুজিবকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

  ৯. সাধারণ নির্বাচন:
পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে গণ-অসন্তোষের ফলে পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৬০টি আসনে জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের ১৪০টি আসনের মধ্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোর পিপলস পার্টি ৮১টি আসন পায়। এভাবে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান রচনার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে (১লা মার্চ, ১৯৭১ খ্রি.) পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।

 ১০. ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ববাংলার সর্বত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান সমগ্র বাঙালি জাতিকে আন্দোলনে সামিল করেন। তিনি ৭ই মার্চ ঘোষণা করেন যে, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। ২৫শে মার্চ পাক সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। শেখ মুজিব তাঁর আগুন-ঝরা বক্তৃতায় বাঙালি জাতিকে নিদের্শ দেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’, ‘তোমাদের যা কিছু আছে তা নিয়েই সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ো। এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই’। ২৬ শে মার্চ মুজিবর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৬শে মার্চে মুজিবরের স্বাধীনতার ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে বলে ধরা হয়। মুজিবরের উন্মাদনাময়ী বক্তৃতা, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং পাক সরকারের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যের খবর আকাশবাণী কলকাতা ধারাবাহিকভাবে প্রচার করলে তা পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি বাঙালির মনে অভূতপূর্ব উন্মাদনার সৃষ্টি করে। এভাবে ২৬শে মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। আওয়ামি লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিবাহিনী প্রচ- আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

 ১১. গণহত্যা:
স্বাধীন বাংলাদেশের দাবিতে পূর্ববঙ্গের মানুষ শেখ মুজিবরের নেতৃত্বে তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও পূর্ববঙ্গের মানুষের উপর নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাক বাহিনীর সহায়তায় এগিয়ে আসে পূর্ববঙ্গের মৌলবাদী আল-বদর, আল-সামস প্রভৃতি রাজাকার বাহিনী। শান্তিপূর্ণ জমায়েতে, গ্রাম বা শহরের লোকালয়ে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হঠা সশস্ত্র পাক-বাহিনী উপস্থিত হয়ে দীর্ঘ ২৬৭ দিন ধরে নির্বিচারে হত্যালীলা চালায়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের গণহত্যার সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী বিশ্বে এটি সবচেয়ে বড়ো গণহত্যা বলে মনে করা হয়। শুধু খুলনায় দেড় লক্ষ, ঢাকায় ১ লক্ষ, চট্টগ্রামে ১ লক্ষ, কুমিল্লায় ৯৫ হাজার, যশোহরে ৭৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল বলে জানা যায়। গণহত্যায় মোট নিহতের সংখ্যা ১০ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ ছিল বলে অনেকে মনে করেন।  অন্তত ৪ লক্ষ বাঙালি নারী ধর্ষিতা হন। এই বীভস হত্যাকা- পুর্ববঙ্গের মানুষকে আরও বেশি করে স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করে।

 ১২. প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা:
পাক সরকার শীঘ্রই মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে। ফলে পূর্ববঙ্গের জাতীয়তাবাদী নেতারা ভারতে আশ্রয় নিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করে (১০ই এপ্রিল)। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সরকার ভারতের মাটি থেকে তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে থাকে।

 ১৩. ভারতের ভূমিকা:
মুক্তি সংগ্রামের সময় বর্বর পাক-বাহিনী পূর্ববঙ্গে পাইকারীভাবে গণহত্যা চালালে পাক হামলা থেকে বাঁচতে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে। ভারত অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ত্রাতার ভূমিকা নিয়ে পূর্ববঙ্গের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় পূর্ববঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি পাক বাহিনীকে পূর্ববঙ্গে কোণঠাসা করে ফেলে। কিন্তু আমেরিকা এবং চিন পাক সরকারকে সমর্থন ও সহায়তা করার ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। অবশেষে ভারত ৩রা ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করে প্রায় ৯০ হাজার পাক সেনাকে বন্দি করে।

 ১৪. পাক বাহিনীর আত্মসমর্পন:
ভারতীয় সেনাবাহিনী ও পূর্ববঙ্গের মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী আকাশ থেকে ঢাকার পাক সেনাদের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ প্রচারপত্র বিলি জানায় যে, সময় থাকতে পাক বাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পন করুক। শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজি ৯৩,০০০ সৈন্যসহ ১৬ই ডিসেম্বর (১৯৭১ খ্রি.) ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল জগজি সিং অরোরা-র কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করেন। এর ফলে দীর্ঘ ৯ মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

 উপসংহার:
বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য পূর্ববঙ্গে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তা ক্রমে ভাষা আন্দোলনের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা লাভ ছিল প্রকৃতপক্ষে ২১শে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা আন্দোলনেরই চূড়ান্ত পরিণতি। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে শীঘ্রই অসংখ্য দেশাত্ববোধক গাণ, কবিতা, সাহিত, নাটক প্রভৃতি রচিত হয়। ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না’- এই ধরনের অসংখ্য সঙ্গীতে বাংলা মুখরিত হয়। এপার বাংলায় সৃষ্ট ভূপেন হাজারিকার কণ্ঠে ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’ গানটি উভয় বাংলাকে দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করে। 


লেখক পরিচিতি

সুভাষ বিশ্বাস, অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, বিদ্যাসাগর মেট্রোপলিটন কলেজ, কলকাতা, ইমেল : subhasbiswaschak@gmail.com

My Photo