Friday, 2 June 2023

মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও। - সুভাষ বিশ্বাস। Muhammad Ghuri's expedition to India. - Subhas Biswas.

 

===========================================================
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।
- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
===========================================================

Muhammad Ghuri's expedition to India.
- ‍Subhas Biswas,
Dept. of History,
University of Kalyani





==================================================

প্রশ্ন: মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।

উত্তর:

ভূমিকা: 
আফগানিস্তানের ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান মুইজউদ্দিন মহম্মদ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসে তিনি মহম্মদ ঘুরি নামেই অধিক পরিচিত। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক মহম্মদ ঘুরি 1173 খ্রিস্টাব্দে গজনী রাজ্য জয় করে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ভারত অভিযানে মন দেন। 

1. উৎস: 
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় চাঁদ বরদই রচিত ‘পৃথ্বীরাজরাসো’, হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’, মিনহাসউদ্দিন সিরাজ রচিত ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরি’ এবং ফেরিস্তা রচিত ‘তারিখ-ই-ফেরিস্তা’ প্রভৃতি গ্রন্থে। 

2. ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য: 
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান মামুদের মতো ভারতের প্রবল ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ দ্বারা মহম্মদ ঘুরি প্রলুব্ধ হলেও ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাই ঘুরির প্রধান লক্ষ্য ছিল। তিনি সীমাহীন ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ভারত আক্রমণ করেন। তবে কোনো প্রকার ধর্মীয় ভাবাবেগ এক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না। অনেকের মতে, খোয়ারিজম সাম্রাজ্যের শাসকদের আক্রমণ থেকে মুক্ত হতেই তিনি ভারত আক্রমণ করেন। 

3. ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ: 
নীচে মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল— 

a. মহম্মদ ঘুরি 1175 খ্রিস্টাব্দে কার্মাথিয়ান বংশীয় শাসকদের পরাজিত করে মুলতান জয় করেন। ওই বছরই তিনি সিন্ধুর উচ্‌ অঞ্চল জয় করেন। 
b. তিনি 1178 খ্রিস্টাব্দে গুজরাট দখলের চেষ্টা করলেও বাখেলা বংশীয় রাজা ভীমদেবের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন। 
c. তিনি 1179 খ্রিস্টাব্দে পেশোয়ার এবং 1185 খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোট দখল করেন। এরপর 1186 খ্রিস্টাব্দে লাহোরের গজনভি রাজ্যের শাসক খুসরু মালিককে পরাজিত করে তিনি লাহোর দখল করেন। এভাবে সমগ্র পাঞ্জাবে ঘুরির আধিপত্য কায়েম হয়। 
d. মহম্মদ ঘুরি 1191 খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও আজমিরের চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এটি ‘তরাইনের প্রথম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে কনৌজ-রাজ জয়চাঁদ ছাড়া উত্তর ভারতের সকল রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে সমর্থন করেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে মহম্মদ ঘুরি ভাতিন্ডা নামক অঞ্চলটি দখল করেন। কিন্তু যুদ্ধের অন্তিম পর্বে পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে সম্মিলিত রাজপুত বাহিনীর আক্রমণে ঘুরির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এরপর ঘুরি কোনোক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গজনীতে পৌঁছান। 
e. মহম্মদ ঘুরি 1192 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করে তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটি ‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রায় 1 লক্ষ 20 হাজার তুর্কি সৈন্য নিয়ে ঘুরি পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন। তুর্কি অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে রাজপুত বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিনহাজ-উস-সিরাজ লিখেছেন, ‘যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে বন্দি করা হয় এবং পরবর্তীতে হত্যা করা হয়।’ এই যুদ্ধ জয়ের পর ঘুরি দিল্লি ও আজমির দখল করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বার্ষিক করদানের বিনিময়ে পৃথ্বীরাজের এক পুত্রকে মহম্মদ ঘুরি আজমিরের শাসকপদে বহাল রাখেন। এরপর কুতুবউদ্দিন আইবক নামে এক বিশ্বস্ত সেনাপতির হাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যের শাসনভার দিয়ে ঘুরি স্বদেশে ফিরে যান। 

4. উপসংহার: 
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করা। তাই সুলতান মামুদের মতো ঘুরি কেবল ধনসম্পদ লুণ্ঠনের দিকে নজর দেননি। বরং তিনি তাঁর বিজিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই ঘুরির অভিযানের মাধ্যমে ভারতে ইসলামি শাসনের সূত্রপাত হয়। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।’ তবে ভারতীয় শাসকদের সামরিক দুর্বলতা ও ঐক্যের অভাবই যে ঘুরির ভারত অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিবরণ। Sultan Mamud's expedition to India.

 

===================================

সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।

- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

===================================

Sultan Mamud's expedition to India.

ভূমিকা: মামুদের পিতা সুলতান সবুক্তগীন একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। তাঁর মৃত্যুর (997 খ্রি.) পর তাঁর পুত্র মামুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাস্ত করে গজনীর সিংহাসনে বসেন (998 খ্রি.)। তাঁর কর্মদক্ষতায় মুদ্ধ হয়ে খলিফা তাঁকে ‘ইয়ামিন উল্লাহ’ উপাধি দেন। এজন্য তাঁর বংশের নাম হয় ‘ইয়ামিন বংশ’। মামুদ 1000-1027 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। গজনীর সুলতান মামুদের ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। 1. ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য: অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের অপরিমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সুলতান মামুদ বারংবার ভারত আক্রমণ করেন। মহম্মদ হাবিব তাঁর ‘Mahmud of ghazni’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “মামুদ কোনো ধর্মপ্রচার করেননি, ধর্মান্তর করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।” মামুদের দরবারি ঐতিহাসিক উতবি তাঁর ‘তারিখ-ই-ইয়ামিনি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “ভারত অভিযানের দ্বারা মামুদ নিজ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি মহৎ কর্তব্য পালন করেছেন।” অর্থাৎ মামুদের ভারত অভিযান ছিল বিধর্মীদের বিনাশ করার প্রয়াস। 2. মামুদের অভিযানের বিবরণ: এইচ. ইলিয়ট তাঁর ‘History of India, as told by its own Historians’ গ্রন্থে মামুদের ভারত আক্রমণের বিবরণ রয়েছে। a. প্রথম অভিযান: মামুদ 1000 খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ভারত আক্রমণ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে কয়েকটি দুর্গ দখল করেন। b. দ্বিতীয় অভিযান: 1001 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অভিযানে মামুদ শাহীরাজ্য আক্রমণ করে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন। এরপর শাহীরাজ্যের দায়িত্ব পুত্র আনন্দপালের হাতে দিয়ে জয়পাল আত্মঘাতী হন। c. তৃতীয় অভিযান: 1004-05 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় অভিযানে তিনি ভীরা রাজ্যটি দখল করেন। d. চতুর্থ অভিযান: 1005-06 খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ অভিযানে তিনি মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ দাউদ এবং শাহী রাজ্যের আনন্দপালকে পরাস্ত করেন। e. পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযান: [1] 1008 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম অভিযানে তিনি আনন্দপালের পুত্র সুখপালকে (নওশা শাহ) পরাজিত করে সমগ্র মুলতানকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ফলে রাজ্যচ্যুত আনন্দপাল উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লি ও আজমিরের শাসকদের নিয়ে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। [2] কিন্তু ষষ্ঠ অভিযানে মামুদ এই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। f. সপ্তম অভিযান: 1009 খ্রিস্টাব্দে সপ্তম অভিযানে মামুদ পুনরায় আনন্দপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্যের রাজধানী নন্দনহ দখল করেন। ফলে আনন্দপাল মামুদের বশ্যতা স্বীকার করেন। g. অষ্টম অভিযান: 1010 খ্রিস্টাব্দে অষ্টম অভিযানে তিনি মুলতানের বিদ্রোহী শাসক আবুল ফতে দাউদকে পরাজিত করেন। h. নবম অভিযান: 1011 খ্রিস্টাব্দে নবম অভিযানে মামুদ থানেশ্বর আক্রমণ করে প্রচুর ধনরাশি লুণ্ঠন করেন এবং চক্রস্বামীর মূর্তি গজনীতে নিয়ে যান। i. দশম ও একাদশ অভিযান: 1012-13 খ্রিস্টাব্দে দশম ও একাদশ অভিযানে তিনি কাশ্মীরের ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্য দখল করেন। j. দ্বাদশ অভিযান: 1018 খ্রিস্টাব্দে দ্বাদশ অভিযানে মামুদ কনৌজ ও মথুরা লুণ্ঠন করেন এবং সাতটি দুর্গ দখল করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে মথুরার রাজা কুলচাঁদ আত্মঘাতী হন। k. ত্রয়োদশ অভিযান: 1020-21 খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ অভিযানে তিনি চান্দেল্ল বংশীয় রাজা বিদ্যাধরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ত্রিলোচনপাল তাঁকে বাধা দেন। মামুদ ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করেন। l. চতুর্দশ অভিযান: 1021 খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ অভিযানে তিনি ত্রিলোচনপালের পুত্র ভীমপালকে পরাজিত করে শাহী বংশের অবসান ঘটান এবং পাঞ্জাব রাজ্য গজনী সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। m. পঞ্চদশ অভিযান: 1021-22 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ অভিযানে তিনি গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর ও চান্দেল্ল শাসকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। যুদ্ধে চান্দেল্ল রাজা বিদ্যাধর মামুদের কাছে পরাজিত হন। n. ষোড়শ অভিযান: 1024 খ্রিস্টাব্দে ষোড়শ অভিযানে মামুদ গুজরাটের চালুক্য রাজা ভীমকে পরাস্ত করেন। এরপর সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন এবং প্রভূত ধনসম্পদ গজনীতে নিয়ে যান। এই অভিযানে তিনি অসংখ্য নরনারীকে হত্যা করেন। o. সপ্তদশ অভিযান: ভারতে মামুদের সর্বশেষ অভিযান ছিল 1027 খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর জাঠদের বিরুদ্ধে অভিযান। 3. উপসংহার: শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে মামুদের ভারত অভিযান তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই অভিযান ভারতীয় রাজাদের সামরিক দুর্বলতাকে প্রকট করে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীকালে বৈদেশিক আক্রমণের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। সুলতান মামুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “সুলতান মামুদ ছিলেন এক ক্ষমতাশালী লুণ্ঠনকারী দস্যু।”

তুর্কি আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন? Causes of failure of Indian states to resist Turkish invasion.

 

তুর্কি আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

- সুভাষ বিশ্বাস,

ইতিহাস বিভাগ,

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

=====================================================================

Causes of failure of Indian states to resist Turkish invasion.



ভূমিকা: খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম শতক থেকে উত্তর ভারত বৈদেশিক আক্রমণকারীদের কাছে স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে। তখনও পর্যন্ত আক্রমণকারীরা ভারতের অভ্যন্তরে ঢোকার চেষ্টা করেনি। এই পথ ধরে পরবর্তীকালে দশম শতকের শেষ ও একাদশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতে প্রথম তুর্কি আক্রমণ শুরু হয়। তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। তখন বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্বল স্থানীয় শাসকদের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আঞ্চলিকতার ভাবই বড় হয়ে ওঠে। এই সুযোগে বহিরাগত তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করে সাফল্য পায়। তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থতার কারণগুলি নীচে আলোচনা করা হল—

1. কেন্দ্রীয় শক্তির অভাব: তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় শক্তি এবং স্থানীয় শক্তিগুলির মধ্যে সর্বভারতীয় চেতনার অভাব ছিল। তারা নিজ নিজ রাজ্যের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি আগ্রহী ছিল। বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ শক্তিজোট গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না। উপরন্তু তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে মত্ত ছিল। ফলে স্থানীয় ভারতীয় শক্তিগুলি তুর্কি আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। বেশকিছু শক্তিশালী রাজপুত রাজ্য তুর্কি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আর তুর্কিরা জয়লাভ করে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

2. দক্ষ নেতৃত্বের অভাব: তুর্কি সেনাবাহিনীতে মহম্মদ ঘুরি ও কুতুবউদ্দিন আইবকের মতো সুদক্ষ সামরিক নেতৃত্ব ছিল। তাদের সমগোত্রীয় নেতা ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে ছিল না। বিভিন্ন জাতির লোকেদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল ভারতীয় বাহিনীকে একই রণকৌশলে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য তাদের রণকৌশলে কোনো ঐক্য ও সংহতি ছিল না। একই রাজ্যের ভারতীয় বাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন রণকৌশল ও রণদক্ষতা দেখা যেত। তাছাড়া ভারতীয় বাহিনীতে কোনো আদর্শবাদ না থাকায় তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে।

3. ত্রুটিপূর্ণ রণকৌশল: ভারতীয় রাজপুত সেনা সংগঠন ও যুদ্ধ কৌশল ছিল প্রাচীন ধাঁচের। তারা নিজেদের প্রাচীন ধারাকে জগতের সেরা রণনীতি বলে মনে করত। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার উন্নত বল্লমধারী অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর নতুন রণকৌশল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপর কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। তারা গুপ্তচরের মাধ্যমে তুর্কিদের মতো শত্রুর গতিবিধির খবর রাখত না। ভারতীয় রাজপুত সেনাদের যুদ্ধনীতি ছিল মূলত আত্মরক্ষামূলক। তারা ডানে, বামে ও মাঝে— এই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ ও ছত্রভঙ্গ করত।

4. শক্তিশালী তুর্কি সামরিক সংগঠন: সামরিক দিক থেকে ভারতীয় রাজপুত সেনাদের চেয়ে তুর্কিরা ছিল উন্নত। তারা রাজপুতদের রণকৌশল বুঝে আক্রমণাত্মক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করে। তাদের যুদ্ধনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ না করে শত্রুপক্ষকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করা। তুর্কি ঘোড়-সওয়াররা জনপদগুলি এড়িয়ে ছুটন্ত অবস্থায় তীর ছুঁড়ত এবং বল্লম দ্বারা শত্রুকে আঘাত করত। এই ধরনের নিত্যনতুন রণকৌশল সম্পর্কে ভারতের রাজপুত সেনাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় পদাতিক বাহিনী ও তরবারির ব্যবহারে অভ্যস্ত রাজপুত সেনারা এই দুর্ধর্ষ তুর্কি সেনাদের মোকাবিলা করতে পারেনি।

5. রাজপুত রাজাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব: রাজপুত রাজারা নিজ নিজ স্বার্থ-রক্ষার্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন ভারতীয় শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে তুর্কিদের প্রতিরোধ করার মতো সুযোগ্য নেতা রাজপুতদের মধ্যে তৈরি হয়নি। সমাজে ধনবন্টনের কোনো পদ্ধতি না থাকায় উচ্চবর্গের লোকেরা সম্পদশালী হলেও নিম্নবর্গের লোকেরা ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। তারা রাজপুত নেতাদের কাছ থেকে সামাজিক ন্যায়বিচার পায়নি। এ প্রসঙ্গে আলবিরুনী মন্তব্য করেছেন যে, “হিন্দুদের কোনো ব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ত, তাকে সংস্কার করে তার পূর্ণ জীবনদানের কোনো আগ্রহ দেখা যেত না।”

6. হিন্দু সমাজের দুরবস্থা: আর. সি. দত্ত, ড. হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ভারতীয়দের পরাজয়ের জন্য মূলত হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল নীতিকে দায়ী করেছেন। এর জন্য মূলত জাতিভেদ প্রথাকে দায়ী করা যেতে পারে। হিন্দুদের প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সকল সুযোগ-সুবিধা পেলেও নিম্নবর্ণের পতিত ও অস্পৃশ্য মানুষ ছিল অবহেলিত। একমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দেরই ধর্মশাস্ত্র পাঠ ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। তাই তুর্কি আক্রমণকারীদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই শ্রেণি নিষ্ক্রিয় থাকে।

7. কুসংস্কার ও অবক্ষয়: বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতির মতো কুপ্রথা তৎকালীন হিন্দু সমাজকে জর্জরিত করে। সমাজে কোনো নৈতিকতা ও আদর্শবাদ না থাকায় হিন্দুসমাজ অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুসংস্কার ও কুপ্রথার পালন তৎকালীন সমাজের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। নানা সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যভিচার ও অবিচার হিন্দু সমাজকে পুঙ্গ করে দেয়। বিভিন্ন কুসংস্কার ও কুপ্রথায় বিভক্ত হিন্দু সমাজে জাতীয় চেতনার অভাব দেখা দেয়। প্রজাদের মধ্যে যুগোপযোগী রাষ্ট্র গঠনের নীতিগত চেতনার অভাব ছিল। ফলে তুর্কিদের মতো শক্তিশালী বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হয়।

8. সামন্তপ্রথা: তুর্কি বিজয়ের প্রাক্কালে রাজপুত রাজ্যগুলিতে সামন্তপ্রথা প্রচলিত ছিল। ফলে তৎকালীন স্থানীয় শক্তিগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হয়। এই প্রথায় অভিজাত ও বণিকরা বিলাস-ব্যসনে দিন কাটালেও সাধারণ কৃষক-কারিগর শ্রেণী ছিল অবহেলিত। তুর্কি আক্রমণের সময় অবহেলিত ও বঞ্চিত এই শ্রেণী নীরব ভূমিকা পালন করে।

9. উপসংহার: ///