===========================================================
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।
- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
===========================================================
Muhammad Ghuri's expedition to India.
- Subhas Biswas,
Dept. of History,
University of Kalyani
==================================================
প্রশ্ন: মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।
উত্তর:
ভূমিকা:
আফগানিস্তানের ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান মুইজউদ্দিন মহম্মদ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসে তিনি মহম্মদ ঘুরি নামেই অধিক পরিচিত। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক মহম্মদ ঘুরি 1173 খ্রিস্টাব্দে গজনী রাজ্য জয় করে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ভারত অভিযানে মন দেন।
1. উৎস:
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় চাঁদ বরদই রচিত ‘পৃথ্বীরাজরাসো’, হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’, মিনহাসউদ্দিন সিরাজ রচিত ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরি’ এবং ফেরিস্তা রচিত ‘তারিখ-ই-ফেরিস্তা’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
2. ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য:
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান মামুদের মতো ভারতের প্রবল ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ দ্বারা মহম্মদ ঘুরি প্রলুব্ধ হলেও ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাই ঘুরির প্রধান লক্ষ্য ছিল। তিনি সীমাহীন ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ভারত আক্রমণ করেন। তবে কোনো প্রকার ধর্মীয় ভাবাবেগ এক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না। অনেকের মতে, খোয়ারিজম সাম্রাজ্যের শাসকদের আক্রমণ থেকে মুক্ত হতেই তিনি ভারত আক্রমণ করেন।
3. ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ:
নীচে মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
a. মহম্মদ ঘুরি 1175 খ্রিস্টাব্দে কার্মাথিয়ান বংশীয় শাসকদের পরাজিত করে মুলতান জয় করেন। ওই বছরই তিনি সিন্ধুর উচ্ অঞ্চল জয় করেন।
b. তিনি 1178 খ্রিস্টাব্দে গুজরাট দখলের চেষ্টা করলেও বাখেলা বংশীয় রাজা ভীমদেবের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন।
c. তিনি 1179 খ্রিস্টাব্দে পেশোয়ার এবং 1185 খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোট দখল করেন। এরপর 1186 খ্রিস্টাব্দে লাহোরের গজনভি রাজ্যের শাসক খুসরু মালিককে পরাজিত করে তিনি লাহোর দখল করেন। এভাবে সমগ্র পাঞ্জাবে ঘুরির আধিপত্য কায়েম হয়।
d. মহম্মদ ঘুরি 1191 খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও আজমিরের চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এটি ‘তরাইনের প্রথম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে কনৌজ-রাজ জয়চাঁদ ছাড়া উত্তর ভারতের সকল রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে সমর্থন করেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে মহম্মদ ঘুরি ভাতিন্ডা নামক অঞ্চলটি দখল করেন। কিন্তু যুদ্ধের অন্তিম পর্বে পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে সম্মিলিত রাজপুত বাহিনীর আক্রমণে ঘুরির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এরপর ঘুরি কোনোক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গজনীতে পৌঁছান।
e. মহম্মদ ঘুরি 1192 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করে তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটি ‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রায় 1 লক্ষ 20 হাজার তুর্কি সৈন্য নিয়ে ঘুরি পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন। তুর্কি অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে রাজপুত বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিনহাজ-উস-সিরাজ লিখেছেন, ‘যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে বন্দি করা হয় এবং পরবর্তীতে হত্যা করা হয়।’ এই যুদ্ধ জয়ের পর ঘুরি দিল্লি ও আজমির দখল করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বার্ষিক করদানের বিনিময়ে পৃথ্বীরাজের এক পুত্রকে মহম্মদ ঘুরি আজমিরের শাসকপদে বহাল রাখেন। এরপর কুতুবউদ্দিন আইবক নামে এক বিশ্বস্ত সেনাপতির হাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যের শাসনভার দিয়ে ঘুরি স্বদেশে ফিরে যান।
4. উপসংহার:
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করা। তাই সুলতান মামুদের মতো ঘুরি কেবল ধনসম্পদ লুণ্ঠনের দিকে নজর দেননি। বরং তিনি তাঁর বিজিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই ঘুরির অভিযানের মাধ্যমে ভারতে ইসলামি শাসনের সূত্রপাত হয়। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।’ তবে ভারতীয় শাসকদের সামরিক দুর্বলতা ও ঐক্যের অভাবই যে ঘুরির ভারত অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
No comments:
Post a Comment