===================================
সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।
===================================
ভূমিকা: মামুদের পিতা সুলতান সবুক্তগীন একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। তাঁর মৃত্যুর (997 খ্রি.) পর তাঁর পুত্র মামুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাস্ত করে গজনীর সিংহাসনে বসেন (998 খ্রি.)। তাঁর কর্মদক্ষতায় মুদ্ধ হয়ে খলিফা তাঁকে ‘ইয়ামিন উল্লাহ’ উপাধি দেন। এজন্য তাঁর বংশের নাম হয় ‘ইয়ামিন বংশ’। মামুদ 1000-1027 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। গজনীর সুলতান মামুদের ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। 1. ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য: অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের অপরিমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সুলতান মামুদ বারংবার ভারত আক্রমণ করেন। মহম্মদ হাবিব তাঁর ‘Mahmud of ghazni’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “মামুদ কোনো ধর্মপ্রচার করেননি, ধর্মান্তর করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।” মামুদের দরবারি ঐতিহাসিক উতবি তাঁর ‘তারিখ-ই-ইয়ামিনি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “ভারত অভিযানের দ্বারা মামুদ নিজ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি মহৎ কর্তব্য পালন করেছেন।” অর্থাৎ মামুদের ভারত অভিযান ছিল বিধর্মীদের বিনাশ করার প্রয়াস। 2. মামুদের অভিযানের বিবরণ: এইচ. ইলিয়ট তাঁর ‘History of India, as told by its own Historians’ গ্রন্থে মামুদের ভারত আক্রমণের বিবরণ রয়েছে। a. প্রথম অভিযান: মামুদ 1000 খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ভারত আক্রমণ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে কয়েকটি দুর্গ দখল করেন। b. দ্বিতীয় অভিযান: 1001 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অভিযানে মামুদ শাহীরাজ্য আক্রমণ করে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন। এরপর শাহীরাজ্যের দায়িত্ব পুত্র আনন্দপালের হাতে দিয়ে জয়পাল আত্মঘাতী হন। c. তৃতীয় অভিযান: 1004-05 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় অভিযানে তিনি ভীরা রাজ্যটি দখল করেন। d. চতুর্থ অভিযান: 1005-06 খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ অভিযানে তিনি মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ দাউদ এবং শাহী রাজ্যের আনন্দপালকে পরাস্ত করেন। e. পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযান: [1] 1008 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম অভিযানে তিনি আনন্দপালের পুত্র সুখপালকে (নওশা শাহ) পরাজিত করে সমগ্র মুলতানকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ফলে রাজ্যচ্যুত আনন্দপাল উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লি ও আজমিরের শাসকদের নিয়ে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। [2] কিন্তু ষষ্ঠ অভিযানে মামুদ এই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। f. সপ্তম অভিযান: 1009 খ্রিস্টাব্দে সপ্তম অভিযানে মামুদ পুনরায় আনন্দপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্যের রাজধানী নন্দনহ দখল করেন। ফলে আনন্দপাল মামুদের বশ্যতা স্বীকার করেন। g. অষ্টম অভিযান: 1010 খ্রিস্টাব্দে অষ্টম অভিযানে তিনি মুলতানের বিদ্রোহী শাসক আবুল ফতে দাউদকে পরাজিত করেন। h. নবম অভিযান: 1011 খ্রিস্টাব্দে নবম অভিযানে মামুদ থানেশ্বর আক্রমণ করে প্রচুর ধনরাশি লুণ্ঠন করেন এবং চক্রস্বামীর মূর্তি গজনীতে নিয়ে যান। i. দশম ও একাদশ অভিযান: 1012-13 খ্রিস্টাব্দে দশম ও একাদশ অভিযানে তিনি কাশ্মীরের ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্য দখল করেন। j. দ্বাদশ অভিযান: 1018 খ্রিস্টাব্দে দ্বাদশ অভিযানে মামুদ কনৌজ ও মথুরা লুণ্ঠন করেন এবং সাতটি দুর্গ দখল করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে মথুরার রাজা কুলচাঁদ আত্মঘাতী হন। k. ত্রয়োদশ অভিযান: 1020-21 খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ অভিযানে তিনি চান্দেল্ল বংশীয় রাজা বিদ্যাধরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ত্রিলোচনপাল তাঁকে বাধা দেন। মামুদ ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করেন। l. চতুর্দশ অভিযান: 1021 খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ অভিযানে তিনি ত্রিলোচনপালের পুত্র ভীমপালকে পরাজিত করে শাহী বংশের অবসান ঘটান এবং পাঞ্জাব রাজ্য গজনী সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। m. পঞ্চদশ অভিযান: 1021-22 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ অভিযানে তিনি গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর ও চান্দেল্ল শাসকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। যুদ্ধে চান্দেল্ল রাজা বিদ্যাধর মামুদের কাছে পরাজিত হন। n. ষোড়শ অভিযান: 1024 খ্রিস্টাব্দে ষোড়শ অভিযানে মামুদ গুজরাটের চালুক্য রাজা ভীমকে পরাস্ত করেন। এরপর সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন এবং প্রভূত ধনসম্পদ গজনীতে নিয়ে যান। এই অভিযানে তিনি অসংখ্য নরনারীকে হত্যা করেন। o. সপ্তদশ অভিযান: ভারতে মামুদের সর্বশেষ অভিযান ছিল 1027 খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর জাঠদের বিরুদ্ধে অভিযান। 3. উপসংহার: শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে মামুদের ভারত অভিযান তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই অভিযান ভারতীয় রাজাদের সামরিক দুর্বলতাকে প্রকট করে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীকালে বৈদেশিক আক্রমণের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। সুলতান মামুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “সুলতান মামুদ ছিলেন এক ক্ষমতাশালী লুণ্ঠনকারী দস্যু।”
No comments:
Post a Comment