Saturday, 4 June 2016

রবীন্দ্র চেতনায় অখন্ড ভারত - ড. সঞ্জয় প্রামাণিক






রবীন্দ্র চেতনায় অখন্ড ভারত
. সঞ্জয় প্রামাণিক
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর,
বাংলা বিভাগ,
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ।


বিশ্বের মানব সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরেছেন সৃষ্টি-কর্মের মাধ্যমে। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি একজন দেশপ্রেমিক হিসাবেও তিনি আমাদের কাছে পরিচিত
তাঁর চেতনায় দেশপ্রেম মানে খণ্ডিত ভারত নয়, অখণ্ডিত ঐক্যবদ্ধ ভারত। তিনি  কেবল ভারতের কবি নন, সমগ্র বিশ্বের। তাঁর কর্ম, ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে যেমন ছিল সৃষ্টিশীল প্রতিভার চুড়ান্ত নিদর্শন, তেমনি জীবন-কর্মের মধ্যেও ছিল সম্ভবনার চুড়ান্ত ইঙ্গিতরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন এবং অখণ্ড। কিন্তু এমন এক সময় এল যখন ভারতবর্ষ খণ্ডিত হওয়ার মুখে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন; করেছিলেন রাখী বন্ধন উৎসব, রচনা করেছিলেন স্বদেশ প্রেমমূলক গান, ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছিলেন সকল সম্প্রদায়কেএর মধ্যে কবির স্বদেশ ভাবনার পূর্ণ প্রতিফলন পাওয়া যায়, পাওয়া যায় স্বদেশ প্রেমের কথাও  



      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাধীন ভারতের স্বাদ পেয়ে যান নি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার ছ’বছর পূর্বেই তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন। নানা বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল বটে, তবে তা এল বিশাল ভারত ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করেতিনি এই খণ্ডিত ভারতভূমির স্বাধীনতা চাননি। চেয়েছিলেন অখণ্ড স্বাধীন ভারত। ভারতভূমিকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ‘রাখি’ বন্ধন উৎসবের মাধ্যমে সমগ্র ভারতকে এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। এই ‘রাখি’ বন্ধন উৎসব মিলন, প্রেম, ঐক্য, ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর (৩০-এ আশ্বিন) সকাল বেলায় কবি নিজে এবং ক্ষেত্রমোহন ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাড়ির ভৃত্যরা এছাড়াও পাড়ার ছেলে-মেয়ে-বউ সকলেই পায়ে হেঁটে শোভাযাত্রা সহকারে – 
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
হে ভগবান

         এই স্বদেশ প্রেম মূলক গান গাইতে গাইতে গঙ্গার ঘাটে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে মিলনোৎসব পালন করলেনএবং ফেরার পথে এক আস্তাবলে প্রবেশ করে মুসলিম ভাইদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃত্বের, প্রেমের বন্ধনে মিলিত হলেন। এই মিলনোৎসব চিতপুরের বড়ো মসজিদের মৌলবিরা হাসি মুখে মেনে নিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাদেশিকতার ও অখণ্ড ভারত প্রেমের বড় পরিচয় পাওয়া যায়।        
           
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ ভাবনা কেবল বাংলাকে ঘিরে নয়; সমগ্র অখণ্ড ভারতকে ঘিরে। অখণ্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান তথা বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলনের কথা ভেবেছিলেন কারণ মিলনই মানুষে মানুষে ঐক সাধন করেতাই তিনি বলেছিলেন,- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন-
শক-হুন-দল পাঠান মোঘল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’  

      অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষকে সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র রূপে দেখেছিলেন কবির আশা ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দেশের সভ্যতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাগরতীরের এই উপমহাদেশ মহাতীর্থে পরিণত হবে। কিন্তু দেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে প্রত্যক্ষ করে তিনি মর্মাহত এবং ব্যথিত হয়ে বলেছিলেন,- ‘...হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম-দ্বারাই পরস্পরকেও জগতের অন্যান্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলিয়া রাখে ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেতাই কবি ধর্মের পরিবর্তে মানবধর্মের কথা বলেছেন; যে মানবধর্ম মানবতা জাগাতে পারে; মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পারে। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অভাবের কথা বলেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন,- স্বদেশিযুগে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল আরোপিত বা অভিনয়ের মত। মুসলমান, হিন্দু ভাইদের আহ্বানে উদ্বেলিত হয়নি। কারণ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। তাই হিন্দু স্বদেশী প্রচারক জল পানের সময় মুসলমান প্রতিবেশীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলে। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র এই বেআব্রু ভাব ছিল। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্মতা গড়ে ওঠেনি। এতে বঙ্গভঙ্গ আরও সহজতর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝেছিলেন বঙ্গভঙ্গ রোধ করা যাবে না, যদি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করা না যায়। সেই কারণেই তিনি ‘রাখি’ বন্ধন উৎসবের মধ্য দিয়ে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে প্রীতিমূলক ও আন্তরিক করতে চেয়েছিলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ছিল অখণ্ড ভারত প্রেম। কেবল হিন্দু-মুসলমান নয়, সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র হয়ে অখণ্ড ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক এক পুণ্যভূমি। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য গ্রন্থের ১০৬ সংখ্যক কবিতায় তিনি সে কথা বলেছেন,- 
“এসো হে আর্য, এসো অনার্য   
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমানভার

     এখানে কবির স্বদেশ প্রেম কেবল দেশবাসীকে নিয়ে নয়; আগত, অনাগত সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে অখণ্ড মানব প্রেম। এই প্রেমই উত্তীর্ণ হয়েছে বিশ্বপ্রেমে।    
                      
 ঋষিকল্প মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অখণ্ড ভারতবর্ষের রূপ-সৌন্দর্য কল্পনার সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেই সাধনার মন্ত্র দিয়েই বিশ্বমায়ের স্নেহের আঁচলের সন্ধান পেয়েছেনএখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ব্যক্তি মায়ের তুলনায় দেশমাতৃকাকে তিনি কম সম্মান করেননিসেই সম্মান রক্ষার জন্য গাইলেন- 
“ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর
তোমাতে বিশ্বমায়ের
আঁচল পাতা!”  

       লক্ষ্যণীয় এই গীত-মন্ত্রের মধ্যে আছে কবির সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা বাংলার মাটির কথা; আছে বিশ্বপ্রেমের প্রসঙ্গও। এখানে কবি মননের অখণ্ড ভারতপ্রেম প্রসারিত হয়েছে বিশ্বপ্রেমে। এই প্রসারিত বিশ্বপ্রেমের উৎস বাংলাকে ঘিরেইবাংলার হৃদয় ভারতের সঙ্গে মিশে গেছেএই কথা ভেবে কবি গেয়ে ঊঠলেন,-
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির
হলে জননী!”

      এ সঙ্গীতে কেবল স্বদেশ প্রেমই নেয়; ভারতবর্ষের মর্মবস্তুর হৃদস্পন্দনের ধ্বনিও অনুভূত হয়েছেকবি এই ভাবেই স্বাদেশিকতার অনুশীলন করে নিজেকে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমিক রপে প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশকে পুণ্যভূমি বলেছেন তাই কবির ঋষিকণ্ঠে আবার পুণ্যবাণী উচ্চারিত হয়েছে,- 
‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থ জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে...’ 

      অর্থাৎ ভারতবর্ষকে পুণ্যতীর্থ ভাবা স্বদেশ ভাবনারই ফল। আসলে কবি স্বদেশ ভাবনার ধারনাকে সংস্কার করেছেন। তাঁর স্বদেশ ভাবনা ভৌগোলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা কিম্বা ভাষভিত্তিক ঘেরাটোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। তা ছিল নিঃস্বার্থ-মানবতাবাদের প্রকাশ। আসলে কবি অন্ধ স্বদেশ প্রেমিক ছিলেন না বা সংকীর্ণতাও তাঁর মধ্যে ছিলনা; ছিল উদার এবং মানবতা জাগরণের উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতেই গোরা সত্য সন্ধানী হয়েছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সন্দীপের মধ্যে আদর্শ ও নিষ্ঠা ততটা ছিলনা, তবে ছিল সূক্ষ্ম বিচার বোধ। আর গোরার স্বদেশ প্রেম ছিল স্নিগ্ধ ও শুচিশুভ্র সুন্দরআচার নিষ্ঠা হলেও তার মধ্যে ছিলনা কোন ফাঁকি সেই কারণেই গোরা মিথ্যাকে ছেড়ে সত্যকে লাভ করতে চেয়েছে। এবং আনন্দময়ীকে বলেছে,- ‘মা, তুমিই আমার মা। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই-শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ’ ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গোরা’ উপন্যাস দুটির মধ্যে স্বদেশ চেতনার যে রূপ পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথের বস্তুগত দৃষ্টির পরিচয় দেয়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কেবল দেশ প্রেমিকই নন। তিনি একজন ভারত দ্রষ্ট্রাও বটে। এই ভারত দ্রষ্টার আরও দৃষ্টান্ত আছে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ‘অনুশীলন সমিতি’র মাঠে গাওয়া গানে,- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এ গান কবির একার নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। অর্থাৎ সমগ্র দেশ বাসীর মনে প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন ‘ভারত মাতা’ কোন বিশেষ জাতির নয়, সকল ভারতবাসীর। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।  এই স্বদেশ প্রেমিক যখন বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’ তখন তার মধ্যে একজন ভারত দ্রষ্টাকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ দেশ প্রেমিককে সর্বোপরি একজন স্বাদেশিককে সকল রকম বাঁধা মুক্ত হতে হবে। সঙ্গ না পেলে একলা চলতে হবে।                
 
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তি জীবনে যেমন স্বাদেশিক ছিলেন। তেমনি সাহিত্য, সঙ্গীতেও স্বাদেশিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশবাসীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের কাছে চিরকাল যেমন সাহিত্যিক, তেমনি দেশ-প্রেমিক মহান মানব ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসেও দেশের জন্য সংগ্রামের কথা পাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সংগ্রাম বিশ্বপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-প্রেম বিশ্বপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়ে মানব কল্যানের কথা বলেছেএখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্ন্তজাতিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছেন। তাই এখানে আর সাধারণ ধর্ম চিন্তার কথা নেই, আছে মানব ধর্মের কথা, মহামানবত্বের কথা।

**********


সহায়ক গ্রন্থ :

১) পশ্চিমবঙ্গ (রবীন্দ্র সংখ্যা); তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ; ৩১ বর্ষ, ৪১-৪৬ সংখ্যা।

২) রবীন্দ্র–প্রতিভার পরিচয়; ড. ক্ষুদিরাম দাস; মল্লিক ব্রাদার্স; সেপ্টেম্বর ২০০২।

৩) রবীন্দ্র–রচনাবলী, সুলভ সংস্করণ (১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ১২শ খণ্ড); বিশ্বভারতী। 






Friday, 3 June 2016

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঃ প্রসঙ্গ স্বদেশি আন্দোলন - স্বাতী মৈত্র

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সক্রিয়তা : প্রসঙ্গ স্বদেশি আন্দোলন


- স্বাতী মৈত্র,
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, 
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা।
==============================================





বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিস্তার ছিল সর্বব্যাপী। সাহিত্য, শিল্পকলা, ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, রাজনীতি, দর্শন- কিছুই তাঁর চিন্তার বিষয় থেকে বাদ যায়নি। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, শিল্পী ও শিক্ষাবিদ। তিনি এক হাজারের মতো কবিতা ও দুই হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন এবং অন্ততঃ তিন হাজার ছবিও এঁকেছেন। এগুলির অধিকাংশই তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরের সৃষ্টি।  রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যাণ্ড্রু রোবিনসন উল্লেখ করেছেন যে, যুব (Rabindranath) was not an analytical thinker, always an intuitive one who preferred a poetic analogy to a prosaic argument."  সেজন্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের ঘটনা তাঁর একটি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করা যায়। 
রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচিতি হল তিনি একজন কবি। একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতির উর্দ্ধে তাঁর মনকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতির ক্ষতিকারণ দিকটি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই প্রথম দিকে রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তিনি মনে করতেন যে, রাজনীতি সকল দেশেই নৈতিকতার অবনমন ঘটিয়েছে এবং রাজনীতির ফলেই মিথ্যা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা ও কপটতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-ভাবনা পরবর্তীকালে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কেননা, একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহী হলেও তিনি যেমন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা  করেছেন তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থনেও এগিয়ে এসেছেন।  ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ভারতের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আসে। তবে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের পর রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সমগ্র বিশ্ববাসীর নজর আকৃষ্ট হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তার দ্বারা ইউরোপের সর্বাধিক নজর আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। তাছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রচিত ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ইউরোপের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের স্বেচ্ছাচারী নীতির অন্যতম প্রধান রূপকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়। এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন সংগঠিত হয়। আপাতভাবে কার্জন বৃহৎ বঙ্গ বিভাজনের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এই বঙ্গবিভাগের নেপথ্যে ছিল বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে কার্জনের কুচক্রী উদ্দেশ্য। বাঙ্গালী জাতি ছিল ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে দ্বিখণ্ডিত ও দুর্বল করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়াই ছিল কার্জনের মূল উদ্দেশ্য। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালী জাতি ইংরেজদের এই চক্রান্তকে সমূলে উৎখাৎ করার জন্য স্বদেশি আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। 
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলন কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছিল তা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এই আলোচনার মূল বিষয় হল“রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক আদর্শায়িত গণপ্রতিরোধের চিত্র যা বাংলার নরনারীকে, জাতিকে আনার চেষ্টা করেছিল বাংলা-হৃদয় মঞ্চে।”  স্বদেশি আন্দোলনের শেষ পর্বে (১৯১০ সালে) রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে গোরা একবার ত্রিবেণীসঙ্গমে অগণিত ভারতীয়র সঙ্গে একঘাটে স্নান করে সমগ্র ভারতকে নিজের অন্তরে অনুভব করতে চেয়েছিল। সেখানে গোরার চিন্তায় কাজ করেছিল জাতীয়তাবোধ। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালীর হৃদয়ে সেই জাতীয়তাবোধেরই বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথ গোরার মতো খ-িত ভারতবর্ষের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন না। তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র জাতির আন্দোলনকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাখি বন্ধন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে একতা নির্মাণের পথে।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলন পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থে ‘স্বদেশি’ বলতে বোঝায় ‘নিজের দেশের’। বিলাতী দ্রব্য বর্জন বা বয়কট করে দেশিয় দ্রব্যসামগ্রি ক্রয় করাই ছিল এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কথা। আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল- এদেশে বিলাতী দ্রব্য বর্জন করলে ব্রিটিশরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে পরবে তেমনি দেশিয় দ্রব্য বিক্রি বৃদ্ধি পেলে দেশিয় শিল্প ও অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে। 
তবে বলপ্রয়োগ করে বিলাতী দ্রব্যসামগ্রী বয়কট বা বর্জন করার প্রয়াস শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ তা সমর্থন করেননি। “কারণ, তিনি বুঝেছিলেন এই প্রয়াস ছিল রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত। এতে বাস্তবসম্মত বোধের অভাব ছিল।”  তিনি মনে করতেন যে, শুধুমাত্র বয়কটের দ্বারা বঙ্গীয় সমাজের মূল সমস্যাটিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনে তাঁর লক্ষ্য ছিল যে, মূল স্বদেশির আদর্শ জাতীয় সুপ্ত চেতনার দরজায় আঘাত হানবে আর সেই জাগ্রত চেতনার ফলে তাঁতি শুধু কাজ পাবে না- অনাথ শুধু ত্রাণ পাবে না- তা ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের, জমিদার ও কৃষকের, হিন্দু ও মুসলমানের, ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের অবসান ঘটাবে। কংগ্রেস দলের নেতারা যখন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করলেও জার্মান, অষ্ট্রিয়া বা আমেরিকার পণ্য ব্যবহারে কুণ্ঠাবোধ করেননি তখন স্বদেশিকতার নামে নেতাদের বিভ্রান্তিমূলক নীতির সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কালান্তর’ পত্রিকায় লিখলেন- 
“বস্তুত যখন সমগ্রভাবে দেশের বুদ্ধিশক্তি, কর্মশক্তি উদ্যত থাকে তখন অন্যদেশ থেকে কাপড় কিনে পড়লেও স্বরাজের মূলে আঘাত লাগে না। গাছের গোড়ায় বিদেশি সার দিলে গাছ বিদেশি হয় না।”  বা “খদ্দর পরা দেশই যে সমগ্র দেশের সম্পূর্ণ আদর্শ একথা আমি কোন মতেই মানতে পারি নে।”
একদা রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা ক্রমশ ভিন্নপথে প্রবাহিত হতে থাকে। তিনি বলেন যে, রাজনীতি তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ হলেও তিনি যে দেশে, যে পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আবর্তে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে যখন স্বদেশি আন্দোলন শুরু হল তখন রবীন্দ্রনাথ শীঘ্রই তাতে জড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রচারিত হলে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে (২২ জুলাই) ‘স্বদেশি সমাজ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি বঙ্গভঙ্গের মূল সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং কীভাবে এর প্রতিকার সম্ভব তার-ও ব্যাখ্যা দেন। তিনি গণ স্বাক্ষর সম্বলিত তীব্র কটাক্ষপূর্ণ 'Memorial' ইংরেজ রাজদরবারে পাঠান। ১৯০৫ সালে কার্জন দুই বাংলা বিভক্ত করলে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন প্রসঙ্গে স্বদেশি গান লিখতে, বক্তব্য রাখতে এবং গণ মিছিলে অংশ নিতে শুরু করলেন। স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসাবে তিনি একটি দেশলাই কারখানা, একটি ব্যাঙ্ক এবং একটি তাঁতশিল্প কেন্দ্র স্থাপন করেন। আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি ১২টি স্বদেশি সঙ্গীত রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ ইত্যাদি। এভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্নভাবে নেতৃত্বদান করেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ থাকলেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলন ছিল এমনই একটি রাজনৈতিক বিষয় যার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রবীন্দ্রনাথের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। 
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যেদিন কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে দ্বিখ-িত করেন, সেদিন এর প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ‘রাখিবন্ধন’ উৎসবের সূচনা করেন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের অস্ত্র চালনার দ্বারা দুই বাংলা বিভাজিত হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় বাঙ্গালী ভাইবোনেরা একে অপরের হাতে রাখি বেধে মনের অখ-তা প্রকাশ করে। তাঁর প্রেরণায় হাজার হাজার মানুষ গঙ্গার ধারে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে মিছিল করে শহর পরিক্রমা করে। হিন্দু ও মুসলিম ভাইবোনেরা সৌভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেয়। দুই বাংলার মানুষের মনোজগতের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে রাখিবন্ধনের উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান-
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,
পুণ্য হউক, হে ভগবান। 
প্রথমদিকে স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা ছিল অহিংস ও অসহযোগ। কিন্তু যখন কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা অহিংস অসহযোগের পথ পরিহার করে আন্দোলনকে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী পথে পরিচালিত করেন তখন রবীন্দ্রনাথ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যারা আপাতভাবে নিরীহ এবং এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন, তাদের যখন জোর করে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তিনি প্রমাদ গণেন।  রবীন্দ্রনাথের আন্দোলন এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধেও। তিনি মনে করেন যে, যে ব্যক্তির ধর্ম অন্যের ধর্মকে অবজ্ঞা করতে শেখায়, যার সবকিছুই প্রতিবেশির স্পর্শে অপবিত্র হয়ে যায়, অন্যের ধর্মের অবমাননা করেই যার পবিত্রতা রক্ষা করতে হয় সেই ব্যক্তি অবমাননারই যোগ্য।  রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের এই কুৎসিত দিকগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে গঠনমূলক স্বদেশির প্রচার হোক। সমাজে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি চেয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগগুলি উপলব্ধি করুক।  রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চরমপন্থী ও নরমপন্থী আদর্শের বিরোধ ও বাড়াবাড়িকে বা বাইরে থেকে আন্দোলনের মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়াকেও সমর্থন করেননি। তাছাড়া তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, আন্দোলনে ক্রমে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম সমাজকে আন্দোলন থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। তাই মুসলিমদের অনেকেই মনে করতেন যে, এটি আসলে হিন্দুদের আন্দোলন। তাই তারা এই আন্দোলনে আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি।  তাছাড়া আন্দোলনের সময় এক শ্রেণির পুনরুজ্জীবনবাদীর উদ্যোগে সমাজে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি পায়। কিছু জাতীয়তাবাদী নেতার উৎসাহে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পরিণতিতে ১৯০৬ সালের মে মাস থেকে ১৯০৭ সালের মে মাসের মধ্যে পূর্ববঙ্গে বেশ কয়েক স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে যায়।  
এরপর আন্দোলন ক্রমে সন্ত্রাসবাদী পথে অগ্রসর হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বসু বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ দুই ইংরেজকে হত্যা করেন। অহিংস অসহযোগ থেকে আন্দোলন ক্রমে সহিংস আগ্রাসী পন্থায় পরিচালিত হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তিনি তাঁর বহু স্বদেশবাসীর বিভিন্ন সমালোচনার শিকার হন। সমালোচকদের কেউ কেউ আবার তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী বলে বিদ্রুপ করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করলেন। স্বদেশি আন্দোলনে মোহভঙ্গ হওয়ার পর থেকে তিনি আর কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত করেননি। 
স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বাধিক পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে শুধু সমকালীন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করেছেন তা-ই নয়, এটিই হল ‘সাধু ভাষা’ পরিত্যাগ করে ‘চলিত’ বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস।  ফলে তখন থেকেই সংস্কৃত-প্রেমী পণ্ডিতমহল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ "The Home and the World" প্রকাশিত হলে ইউরোপেও এর ব্যাপক সাড়া পড়ে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিখিল, বিমলা ও সন্দীপের চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। নিখিলের চরিত্রে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির ছায়াই দেখতে পাওয়া যায়। উপন্যাসের নিখিল একজন সদয়, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল জমিদার। তার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মানসিকতা নেই, আছে দেশপ্রেম। নিখিলের বন্ধু সন্দীপ ছিল স্বার্থপর এবং স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা হিসাবে চরমপন্থার উগ্র সমর্থক। জাতীয়তাবাদী সন্দীপের নীতিকে নিখিল সমর্থন করেনি। নিখিল ও সন্দীপের পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ফাঁপরে পড়ে যায় নিখিলের স্ত্রী বিমলা। আবেগতাড়িত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে গিয়ে নিখিল ক্রমে সামগ্রিক পরিস্থিতি, এমনকি তার স্ত্রী বিমলার কাছ থেকেও একাকী হয়ে পড়ে। বিমলা ক্রমে সন্দীপের ক্যারিশ্মাটিক ব্যক্তিতে আকৃষ্ট হতে থাকে। স্বদেশি আন্দোলনের নামে সন্দীপ যখন গ্রামের দরিদ্র ও নিরীহ বাসিন্দাদের স্বদেশি দ্রব্যসামগ্রি কেনার জন্য বলপ্রয়োগ শুরু করে তখন নিখিল তাতে সায় দেয়নি। কেননা, স্বদেশি জিনিসপত্রের মূল্য যেমন বিলাতী দ্রব্যের চেয়ে বেশি তেমনি দ্রব্যের গুণগত মান ল্যাঙ্কাশায়ার বা ম্যানচেস্টারে উৎপাদিত দ্রব্যের চেয়ে কম। বাংলার দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে বিলাতী দ্রব্যেরই বেশি প্রয়োজন ছিল। যখন এই দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের উপর ‘স্বদেশির’ নাম করে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বলপ্রয়োগ শুরু করলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমে আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকলেন। তিনি ১৯০৮ সালে প্রকাশিক ‘সদুপায়’ নামে এক প্রবন্ধে একজন বাঙ্গালী হিসাবে আত্মসমালোচনা করে উল্লেখ করলেন যে, আমাদের দুর্ভাগ্যই হল- আমরা স্বাধীনতা চাইলেও আমরা অন্তর থেকে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করিনা। 
নিখিল উপলব্ধি করেছিল যে, বিলাতী দ্রব্য জোর করে বয়কট করলে দেশের দরিদ্র মানুষেরই সবচেয়ে ক্ষতি হবে। কিন্তু নিখিলের প্রতিবাদ সন্দীপের বেপরোয়া চরম দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। সন্দীপের এই বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ক্রমশ খারাপ পথে নিয়ে যেতে  থাকে। সে তার বন্ধু নিখিলের স্ত্রীর সঙ্গেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। একজন মুসলিম মাঝি যখন তার উপার্জন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় স্বদেশিদের নির্দেশ উপেক্ষা করে তার নৌকায় বিলাতী পণ্য পরিবহন অব্যহত রাখে তখন সন্দীপ সেই দরিদ্র মুসলিম মাঝিটির নৌকা জলে ডুবিয়ে দিতে তার একজন অনুগামীকে নিদের্শ দেয়। সন্দীপ তার অনুগামীদের মুসলিম-বিদ্বেষী করে তোলে এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে উদ্দীপ্ত করে। আর নিখিল এই দাঙ্গা প্রশমিত করতে গিয়ে দাঙ্গাতেই তার মৃত্যু হয়। বেপরোয়া সন্দীপের কর্মকা- এবং আদর্শবাদী ও মানবিক নিখিলের চরিত্রের মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আন্দোলনের নামে কীভাবে নৈতিকতার মৃত্যু ঘটছে তা নিখিলের মৃত্যুতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে চিত্রিত নিখিলের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাঙ্গালী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রকাশ করে। সন্দীপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিখিলের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তৎকালীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাখ্যানের  বিষয়টিকেই প্রকাশ করে। স্বদেশি আন্দোলন পরিচালনার পন্থায় তাঁর মোহভঙ্গের বিষয়টি শুধু সাহিত্যে নয়, জাপান ও ব্রিটেনে ১৯১৬-১৭ সালে প্রদত্ত তাঁর বেশ কিছু বক্তৃতায়ও তাঁর এই মোহভঙ্গের বিষয়টি উঠে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সমকালীন সময়ে বিদ্রুপের শিকার হলেও পরবর্তীকালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর রাজনৈতিক পন্থাই সর্বাধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে তাঁর চিন্তিত অহিংস ও অসহযোগ পন্থাই ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের পন্থা হিসাবে গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ও পরিচালনায় অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন সারা দেশের আন্দোলনে তীব্র জোয়ার আনে। স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের পন্থাই গান্ধীজী তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনে সর্বাধিক  প্রয়োগ করেছেন।  তাই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থাকে গান্থীজী তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পূর্বসূরী বরে অভিহিত করা যেতে পারে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়বাদী ও সহাবস্থানের মহান আদর্শ প্রতিটি দেশে, প্রতিটি যুগেই অনুকরণীয় হতে পারে। বর্তমান উন্মত্ত ও হিংসা-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ আরও বেশি করে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 




সূত্র নির্দেশ ঃ
১। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’।
২। Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis: Tapati Dasgupta
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কালান্তর’।
৪। Selected letters of Rabindranath Tagore: Edited by Krishna Dutta, Andrwe Robinson
৫। Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
৬। http:/ww/w.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html : Uma Das Gupta, Anandarup Ray
৭। http:/ww/w.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh


General References:

1| cÖfvZKzgvi gy‡Lvcva¨vq, Ôiex›`ª RxebK_vÕ|
2| Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis: Tapati Dasgupta
3| iex›`ªbv_ VvKz‡ii ÔKvjvšÍiÕ|
4| Selected letters of Rabindranath Tagore: Edited by Krishna Dutta, Andrew Robinson
5| Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
6| http://www.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html : Uma Das Gupta, Anandarup Ray
7| http://www.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh

নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন - সুভাষ বিশ্বাস

নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন

- . সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়






১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৪৯-১৯৫০ সাল নাগাদ পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতনের আগুনের লেলিহান শিখা নেমে এলে সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত হিন্দু শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের ঢল নামে। আগত এই সকল উদ্বাস্তুরা অধিকাংশই পূর্ববঙ্গে তাদের ভিটেমাটি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হারিয়ে একেবারে সহায় সম্বলহীন ছিলেন। তারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রেল-স্টেশনে, ফুটপাতে, রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকার এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের আপাতত আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলায় উদ্বাস্তু ক্যাম্প বা শিবির তৈরী করলেন। রেল স্টেশন, ফুটপাত ও ক্যাম্পগুলিতে উদ্বাস্তুদের জীবন সম্পূর্ণ নারকীয় হয়ে উঠল।
ভয়ানক নারকীয় জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উদ্বাস্তুরা শীঘ্রই রুখে দাঁড়াতে এবং প্রতিবাদী হতে শুরু করল। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাসন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস দল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধী দলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, পি. এস. সি., ফরওয়ার্ড ব্লক, আর. এস. পি. প্রভৃতি। সাধারণ পথে নারকীয় জীবন থেকে মুক্তির কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে উদ্বাস্তরা তাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য সরকার ও সরকারী বিভিন্ন পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। রাজ্য কংগ্রেসের বিরোধী বামপন্থী দলগুলি এই পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুদের পাশে এসে তাদের আন্দোলনে সহযোগিতা করতে শুরু করে। ক্রমে উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলিতে বামপন্থী নেতৃবৃন্দই পরিচালকের আসনে চলে আসেন। এই উদ্বাস্তু আন্দোলনের ইতিহাসে নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। কিন্তু ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা অধিকাংশই তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে সামান্য পেয়েছিল বা অনেক উদ্বাস্তু একেবারেই পায়নি। তাই নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু শিবির বা ফুটপাতের উদ্বাস্তুদের যেখান অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানেরই পর্যাপ্ত সংস্থান ছিল না সেখানে উদ্বাস্তুদের শালীনতা রক্ষার জন্য বসবাসের পরিবেশ আশা করা উদ্বাস্তুদের কাছে এক প্রকার বিলাসিতা ছিল। এর সঙ্গে নদীয়ার উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল, শৌচাগার, স্নানাগার প্রভৃতির অভাব, প্রচণ্ড শীতে বা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে তীব্র কষ্টভোগ, ঔষধপত্রের অভাব প্রভৃতি উদ্বাস্তুদের জীবনকে সম্পূর্ণ দুর্বিসহ করে তুলেছিল। এর পাশাপাশি বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ নীতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ নদীয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী তাঁর রচনায় বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা সমর মুখার্জীর উদ্বাস্তু আন্দোলন সম্পর্কিত উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। সমরবাবু উদ্বাস্তু আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতা প্রয়াত অনিল সিংহের স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে তাঁর এই উদ্ধৃতিতে বলেছেন যে, 
“ . . . পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে দলে দলে উদ্বাস্তুরা এসে উপস্থিত হতে বাধ্য হলেন। এই সময়ে নেহেরু সরকার একদিকে পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের বললেন,- ফিরে যেতে। স্বভাবতই এই একপেশে নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠল। ১৯৫০ সাল নাগাদ উদ্বিগ্ন বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত মঞ্চ হিসেবে UCRC আত্মপ্রকাশ করল। . . .”
নদীয়া জেলায় গৌর কুণ্ডু, সুভাষ বোস প্রমুখ বামপন্থী নেতা প্রথম থেকেই এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরের দিকে শান্তিরঞ্জন দাস, অশোক চক্রবর্তী, সমীরণ বসাক প্রমুখ বামপন্থী নেতারাও নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিচালনা করেন। নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে এবং ক্যাম্পের বাইরের বিভিন্ন উদ্বাস্তুদের মধ্যেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গের তকালীন সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলন থেকে নদীয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলন ছিল পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলনেরই একটি ধারা। নদীয়ার এই আন্দোলন বহু ক্ষেত্রেই নদীয়ার বাইরের উদ্বাস্তু আন্দোলনের দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিল তেমনি বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বারাও এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
সরকার বহু ক্ষেত্রেই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দিতে বা তাদের ক্যাম্পে আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হলে বহু উদ্বাস্তু নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থানে বসতি নির্মাণ করে সেখানে জবরদখল কলোনি গড়ে তুলতে থাকে। ১৯৫০-৫১ সালের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় এমন অসংখ্য জবরদখল কলোনি গড়ে ওঠে। উদ্বাস্তুদের এই জবরদখল কলোনিগুলি উচ্ছেদ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার বামপন্থী দলগুলির বিরোধিতার মধ্যেই ১৯৫১ সালে বিধানসভায় ‘উচ্ছেদ বিল’ পাশ করে এবং ১৯৫৭ সালে বিলটির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বিধানসভায় ‘সংশোধনী বিল, ১৯৫৭’ উত্থাপন করে। সরকারের এই উচ্ছেদ আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভার ভেতরে বামপন্থী বিধায়কগণ এবং বাইরে উদ্বাস্তুরা তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে এবং এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। যথারীতি নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তুরা সরকারের এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালের ১০ই জুলাই সমর মুখার্জী বিধানসভায় তাঁর ভাষণে অভিযোগ করেন যে, জমির ধনী মালিকরা তাদের দখল হয়ে যাওয়া জমি ফিরে পাওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিল। সেই চাপে এবং জমির মালিকদের খুশি করার জন্য সরকার নিঃস্ব উদ্বাস্তুদের উখা করে জমি বড় মালিকদের ফিরিয়ে দিতে চায়। যেদিন রাজ্য বিধানসভায় এই উচ্ছেদ বিলটি উত্থাপন করা হয় সেদিন এই বিলের প্রতিবাদ জানাতে বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশেষ করে ইউ. সি. আর. সি.-র নেতৃত্বে ৫০ হাজারের মতো উদ্বাস্তু মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বিধানসভা অভিযান করেন। সমরবাবু সরকারের উদ্বাস্তু-বিরোধী উদ্যোগের প্রতিবাদ করে বলেন যে, সরকার কোন আলোচনা না করে বা বিরোধীদের সঙ্গে কোন পরামর্শ না করে জোর জবরদস্তি করে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারকে তীব্র আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে। সেজন্য তিনি সরকারকে এই সংশোধনী বিল স্থগিত রাখার পরামর্শ দেন।
নারকীয় জীবন থেকে স্বাভাবিকভাবে উদ্বাস্তুদের মুক্তির কোন আশা নেই দেখে তারা সরকারী অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে ক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন শুরু করল। ১৯৫০ সালে গড়ে উঠল উদ্বাস্তুদের সর্ববৃহ সংগঠন ‘সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ’ বা United Central Refugee Council (সংক্ষেপে U.C.R.C.)। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সুকৌশলে এর নেতৃত্ব গ্রহণ করে উদ্বাস্তুদের সমর্থনে সরকার-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন। এর প্রথম সভাপতি হলেন প্রখ্যত বিপ্লবী শ্রীঅম্বিকা চক্রবর্তী। ইতিমধ্যে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং তকালীন হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড সমর মুখার্জী পার্টির নির্দেশে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং উদ্বাস্তু আন্দোলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা, সমিতি ও সম্মেলনে যোগদান করতে শুরু করেন। ১৯৫৭ সাল ও তার পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে নদীয়ার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, রূপশ্রী ক্যাম্প-সহ অন্যান্য জেলার বিভিন্ন ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের উপর সরকারী অবহেলা ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য বিধানসভায় সমর মুখার্জী, হেমন্তকুমার বসু, জ্যোতি বসু, মনোরঞ্জন হাজরা প্রমুখ তাদের বক্তব্য তুুলে ধরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৫৭ সালের ৬ই জুন সমর মুখার্জী বিধানসভায় রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ আনেন।
সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ অর্থা ইউ. সি. আর. সি. ১৯৫০ সালের ১২ই আগস্ট ইউনিভারসিটি ইনষ্টিট্যুট হলে তাদের সম্মেলন এবং ১৩ই আগস্ট কলকাতার ময়দানে প্রকাশ্য অধিবেশন উপলক্ষে সংগঠনটি বাস্তুহারাদের ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দেয় এবং তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কথা জানিয়ে তাদের প্রথম ইস্তাহার প্রকাশ করে। এতে উদ্বাস্তুদের প্রতি উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করা হয় যে,
“ভাইসব - বাস্তুহারা সমস্যা বর্ত্তমানে বাংলার তথা সমগ্র ভারতের জাতীয় জীবনের প্রথম ও প্রধান সমস্যা। . . . সরকার চরম ঔদাসীন্য ও বাস্তুহারাদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতার অভাব এতদুভয়ের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ সর্ব্বনাশ ঘটাইতে সমুদ্যত হইয়া উঠিয়াছে। বাস্তুহারাদের বিরুদ্ধে এই দেশব্যাপী নারকীয় ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করিবার জন্য ও লৌহ কঠিন ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের ভিত্তিতে বাস্তুহারাদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে তীব্র আন্দোলন সৃষ্টির জন্য দলে দলে আসন্ন সম্মেলনে যোগদান করুন। ১১৫, এ আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটে সম্মেলনে প্রস্তুতি কমিটির সম্পাদকের নিকটে প্রতিটি এলাকা, প্রতিটি উদ্বাস্তু শিবির ও উপনিবেশ হইতে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দের নাম ও যথাশক্তি আর্থিক সাহায্য পাঠাইয়া উদ্বাস্তু পুনর্ব্বসতির আন্দোলনকে জয়যুক্ত করুন।”
অম্বিকা চক্রবর্তীর পর ইউ. সি. আর. সি.-র সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সমরবাবুকে। তিনি দীর্ঘদিন এই পদে থেকে ইউ. সি. আর. সি.-র নদীয়া-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার, এমনকি দূরদূরান্তের বিভিন্ন রাজ্যের বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরেন। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার অন্তর্গত বেতাই বাজারটি উচ্ছেদের জন্য পাবলিক ওয়ার্কার্স ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ মামলা করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেতাই বাজার কমিটির পক্ষ থেকে পরিমল বাগচী ও মনোরঞ্জন ব্যানার্জীকে নিয়ে সমর মুখার্জী ও নিরঞ্জন সেন ২৭শে নভেম্বর বিধানসভা ভবনে তকালীন পূর্তমন্ত্রী খগেন দাশগুপ্তের কাছে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন এবং বেতাই বাজার উচ্ছেদ রদ করার দাবি জানান। অবশেষে বেতাই বাজার উচ্ছেদ রদ করা সম্ভব হয়।
নদীয়া জেলায় ইউ. সি. আর. সি. ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে। নদীয়ার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী পল্লী হয়ে ওঠে এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তাই ইউ. সি. আর. সি.-র প্রথম (১৯৫০ সাল), দ্বিতীয় (১৯৫১ সাল) ও তৃতীয় (১৯৫৫ সাল) সম্মেলন যথাক্রমে কলকাতা বা কলকাতার সন্নিহিত বেলঘরিয়ায় অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৫৭ সালে ইউ. সি. আর. সি.-র চতুর্থ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় নদীয়া জেলার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে। ফলে নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলনের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী নেতাদের উদ্যোগে যে খাদ্য আন্দোলন শুরু হড় তাতে নদীয়ার উদ্বাস্তুরা ব্যাপকভাবে অংশ নিয়ে আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল। কৃষ্ণনগরের খাদ্য আন্দোলনের জমায়েতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসত রানাঘাট-সহ নদীয়া জেলার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরগুলি থেকে। নদীয়া থেকে আগত বৃহ উদ্বাস্তু মিছিলের জন্য কলকাতার সমাবেশগুলিতেও খাদ্য আন্দোলনের নেতারা অপেক্ষা করে থাকতেন।১০
এরপর থেকে নদীয়া জেলায় আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন নতুন গতিতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালের ২রা জুন থেকে ৪ঠা জুন রানাঘাটের রূপশ্রী পল্লীতে ইউ. সি. আর. সি.-র ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সময় নদীয়া জেলা বাস্তুহারা পরিষদের সম্পাদক ছিলেন গৌর কুণ্ডু। রানাঘাটের উল্লেখযোগ্য উদ্বাস্তু নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী  ইউ. সি. আর. সি.-র উক্ত সম্মেলনের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হন। তকালীন কংগ্রেস সরকার রানাঘাটের রূপশ্রী পল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য ইউ. সি. আর. সি.-র ষষ্ঠ সম্মেলন বানচাল করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, গৌর কুণ্ডু, সমর মুখার্জী, প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রমুখ উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতাকে ৬০ দিনের ভেতর রানাঘাট ও তার নিকটবর্তী কুপার্স ক্যাম্প, রূপশ্রী ক্যাম্প, নাসরা কলোনী, কীর্তিনগর কলোনী, নোকারি এবং বৈদ্যপুর ইউনিয়ন এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এরূপ তীব্র দমননীতির ফলে উদ্বাস্তু নেতারা রূপশ্রী পল্লীতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে পারেননি। তবে নেতারা সরকারী দমননীতিতে সম্পূর্ণ পিছিয়ে না গিয়ে সম্মেলনের স্থান পরিবর্তন করেন। রানাঘাটে সম্মেলনের যে তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছিল তা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়ে ৯ জুন থেকে ১১ জুন ২৪ পরগণা জেলার সোদপুরের ‘তীর্থ ভারতী’তে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।১০
ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে সরকারী ডোল বন্ধ ও বহু উদ্বাস্তুকে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হলে নদীয়ার রানাঘাটের উদ্বাস্তু আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। নদীয়ার বামপন্থী নেতা তথা নদীয়া জেলার বাস্তুহারা সমিতির সম্পাদক আইনজীবী গৌর কুণ্ডু রানাঘাটের বিভিন্ন ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর নেতৃত্বে কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী ক্যাম্পের উদ্বাস্তুরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে সরকার ২৫শে এপ্রিল, ১৯৬১ তারিখে গৌর কুণ্ডু সহ ১৪ জন উদ্বাস্তু আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের খোঁজে এবং ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করার জন্য পুলিশ কুপার্স ক্যাম্পের বাড়ি বাড়ি হানা দেয়। ২৬শে জুন দমদমের নিকটবর্তী বাগজোলা ক্যাম্পে পুলিশ গুলি চালিয়ে একটি শিশুসহ পাঁচজন উদ্বাস্তুকে হত্যা করে।১১ এই খবর পেয়ে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নদীয়ার রানাঘাটের উদ্বাস্তু নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিতে দেখতে যান। নদীয়ার সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী ছিলেন তখন ইউ. সি. আর. সি.-র রাজ্য সভাপতি।১২
ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবি ও আন্দোলনের ফলে তকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ১৯৫৯ সালের ১৩ই এপ্রিল Rehabilitation Industries Corporation বা সংক্ষেপে আর. আই. সি. গঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের R. R. & R. Department-এর যে ক্ষেত্রগুলি উদ্বাস্তুদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হয়েছিল তা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই সংস্থাটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে কয়েকটি শিল্প ইউনিট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যার মধ্যে নদীয়া জেলায় ছিল তিনটি তাঁত শিল্প ইউনিট। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবিতে বিভিন্ন উদ্বাস্তু আর. আই. সি.-র হেড অফিসের সামনে ৫৫ দিন অবস্থান করে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। অবশ্য পরে ১৯৮৪ সালের ৬ই এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর এই মন্ত্রীসভাই আর. আই. সি. সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবারও উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা সমর মুখার্জী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সরকারের এই সিদ্ধান্তের উপর স্থগিতাদেশ আদায় করতে সক্ষম হন।১৩

তবে নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলনের জয় হোক বা না হোক, এই জেলায় অবশ্যই উদ্বাস্তুদের জীবন-যুদ্ধের জয় হয়েছে। অনাহুত, অবাঞ্ছিত হয়ে নদীয়ায় এসে তারা একদিকে ভোগ করেছে চরম আর্থিক অভাব-অনটন, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে ক্রমাগত ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অপমান, অবজ্ঞা, ঘৃণা, প্রতারণা ইত্যাদি। এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই বাস্তুহারাদের অবিরাম লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফুটপাত, প্লাটফর্ম, উদ্বাস্তু শিবির প্রভৃতি স্থান থেকে যে জনসমাজের অধিকাংশ মানুষের পথ চলা শুরু তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হেরে যায়নি। ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে’ তারা অবশেষে জয়ী হয়েছেন। তাদের অদম্য চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনী, স্কুল, বাজার, সমবায় সমিতি, ক্লাব, রাস্তাঘাট, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ইত্যাদি। নদীয়ার গ্রামের বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠগুলি তারা কোলাহলে ভরিয়ে তুলেছেন। উদ্বাস্তু সমাজকে তার মূল স্রোতের অঙ্গীভূত করে নদীয়া জেলা ক্রমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে।