Friday, 3 June 2016

নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন - সুভাষ বিশ্বাস

নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলন

- . সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়






১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করতে শুরু করে। ১৯৪৯-১৯৫০ সাল নাগাদ পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর তীব্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতনের আগুনের লেলিহান শিখা নেমে এলে সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত হিন্দু শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের ঢল নামে। আগত এই সকল উদ্বাস্তুরা অধিকাংশই পূর্ববঙ্গে তাদের ভিটেমাটি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হারিয়ে একেবারে সহায় সম্বলহীন ছিলেন। তারা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন রেল-স্টেশনে, ফুটপাতে, রাস্তার ধারে, পরিত্যক্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকার এই বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুদের আপাতত আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিভিন্ন জেলায় উদ্বাস্তু ক্যাম্প বা শিবির তৈরী করলেন। রেল স্টেশন, ফুটপাত ও ক্যাম্পগুলিতে উদ্বাস্তুদের জীবন সম্পূর্ণ নারকীয় হয়ে উঠল।
ভয়ানক নারকীয় জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য উদ্বাস্তুরা শীঘ্রই রুখে দাঁড়াতে এবং প্রতিবাদী হতে শুরু করল। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাসন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস দল। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধী দলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি, পি. এস. সি., ফরওয়ার্ড ব্লক, আর. এস. পি. প্রভৃতি। সাধারণ পথে নারকীয় জীবন থেকে মুক্তির কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে উদ্বাস্তরা তাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের জন্য সরকার ও সরকারী বিভিন্ন পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পথে পা বাড়ায়। রাজ্য কংগ্রেসের বিরোধী বামপন্থী দলগুলি এই পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তুদের পাশে এসে তাদের আন্দোলনে সহযোগিতা করতে শুরু করে। ক্রমে উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলিতে বামপন্থী নেতৃবৃন্দই পরিচালকের আসনে চলে আসেন। এই উদ্বাস্তু আন্দোলনের ইতিহাসে নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থান। কিন্তু ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা অধিকাংশই তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে সামান্য পেয়েছিল বা অনেক উদ্বাস্তু একেবারেই পায়নি। তাই নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু শিবির বা ফুটপাতের উদ্বাস্তুদের যেখান অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানেরই পর্যাপ্ত সংস্থান ছিল না সেখানে উদ্বাস্তুদের শালীনতা রক্ষার জন্য বসবাসের পরিবেশ আশা করা উদ্বাস্তুদের কাছে এক প্রকার বিলাসিতা ছিল। এর সঙ্গে নদীয়ার উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে পানীয় জল, শৌচাগার, স্নানাগার প্রভৃতির অভাব, প্রচণ্ড শীতে বা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে তীব্র কষ্টভোগ, ঔষধপত্রের অভাব প্রভৃতি উদ্বাস্তুদের জীবনকে সম্পূর্ণ দুর্বিসহ করে তুলেছিল। এর পাশাপাশি বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ নীতি পশ্চিমবঙ্গ-সহ নদীয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে দুঃখহরণ ঠাকুর চক্রবর্তী তাঁর রচনায় বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা সমর মুখার্জীর উদ্বাস্তু আন্দোলন সম্পর্কিত উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। সমরবাবু উদ্বাস্তু আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য নেতা প্রয়াত অনিল সিংহের স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গে তাঁর এই উদ্ধৃতিতে বলেছেন যে, 
“ . . . পাঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে দলে দলে উদ্বাস্তুরা এসে উপস্থিত হতে বাধ্য হলেন। এই সময়ে নেহেরু সরকার একদিকে পাঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের বললেন,- ফিরে যেতে। স্বভাবতই এই একপেশে নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠল। ১৯৫০ সাল নাগাদ উদ্বিগ্ন বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত মঞ্চ হিসেবে UCRC আত্মপ্রকাশ করল। . . .”
নদীয়া জেলায় গৌর কুণ্ডু, সুভাষ বোস প্রমুখ বামপন্থী নেতা প্রথম থেকেই এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। পরের দিকে শান্তিরঞ্জন দাস, অশোক চক্রবর্তী, সমীরণ বসাক প্রমুখ বামপন্থী নেতারাও নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলন পরিচালনা করেন। নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলিতে এবং ক্যাম্পের বাইরের বিভিন্ন উদ্বাস্তুদের মধ্যেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে, পশ্চিমবঙ্গের তকালীন সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলন থেকে নদীয়া জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলন ছিল পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক উদ্বাস্তু আন্দোলনেরই একটি ধারা। নদীয়ার এই আন্দোলন বহু ক্ষেত্রেই নদীয়ার বাইরের উদ্বাস্তু আন্দোলনের দ্বারা যেমন প্রভাবিত হয়েছিল তেমনি বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির দ্বারাও এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
সরকার বহু ক্ষেত্রেই উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন দিতে বা তাদের ক্যাম্পে আশ্রয় দিতে ব্যর্থ হলে বহু উদ্বাস্তু নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন পরিত্যক্ত স্থানে বসতি নির্মাণ করে সেখানে জবরদখল কলোনি গড়ে তুলতে থাকে। ১৯৫০-৫১ সালের মধ্যেই বিভিন্ন জেলায় এমন অসংখ্য জবরদখল কলোনি গড়ে ওঠে। উদ্বাস্তুদের এই জবরদখল কলোনিগুলি উচ্ছেদ করার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার বামপন্থী দলগুলির বিরোধিতার মধ্যেই ১৯৫১ সালে বিধানসভায় ‘উচ্ছেদ বিল’ পাশ করে এবং ১৯৫৭ সালে বিলটির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য বিধানসভায় ‘সংশোধনী বিল, ১৯৫৭’ উত্থাপন করে। সরকারের এই উচ্ছেদ আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভার ভেতরে বামপন্থী বিধায়কগণ এবং বাইরে উদ্বাস্তুরা তীব্র প্রতিবাদ শুরু করে এবং এই আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। যথারীতি নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তুরা সরকারের এই বিলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৫৭ সালের ১০ই জুলাই সমর মুখার্জী বিধানসভায় তাঁর ভাষণে অভিযোগ করেন যে, জমির ধনী মালিকরা তাদের দখল হয়ে যাওয়া জমি ফিরে পাওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছিল। সেই চাপে এবং জমির মালিকদের খুশি করার জন্য সরকার নিঃস্ব উদ্বাস্তুদের উখা করে জমি বড় মালিকদের ফিরিয়ে দিতে চায়। যেদিন রাজ্য বিধানসভায় এই উচ্ছেদ বিলটি উত্থাপন করা হয় সেদিন এই বিলের প্রতিবাদ জানাতে বিভিন্ন উদ্বাস্তু সংগঠনের পক্ষ থেকে বিশেষ করে ইউ. সি. আর. সি.-র নেতৃত্বে ৫০ হাজারের মতো উদ্বাস্তু মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে বিধানসভা অভিযান করেন। সমরবাবু সরকারের উদ্বাস্তু-বিরোধী উদ্যোগের প্রতিবাদ করে বলেন যে, সরকার কোন আলোচনা না করে বা বিরোধীদের সঙ্গে কোন পরামর্শ না করে জোর জবরদস্তি করে উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করতে গেলে সরকারকে তীব্র আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে। সেজন্য তিনি সরকারকে এই সংশোধনী বিল স্থগিত রাখার পরামর্শ দেন।
নারকীয় জীবন থেকে স্বাভাবিকভাবে উদ্বাস্তুদের মুক্তির কোন আশা নেই দেখে তারা সরকারী অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে ক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে আন্দোলন শুরু করল। ১৯৫০ সালে গড়ে উঠল উদ্বাস্তুদের সর্ববৃহ সংগঠন ‘সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ’ বা United Central Refugee Council (সংক্ষেপে U.C.R.C.)। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সুকৌশলে এর নেতৃত্ব গ্রহণ করে উদ্বাস্তুদের সমর্থনে সরকার-বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন। এর প্রথম সভাপতি হলেন প্রখ্যত বিপ্লবী শ্রীঅম্বিকা চক্রবর্তী। ইতিমধ্যে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং তকালীন হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড সমর মুখার্জী পার্টির নির্দেশে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং উদ্বাস্তু আন্দোলন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সভা, সমিতি ও সম্মেলনে যোগদান করতে শুরু করেন। ১৯৫৭ সাল ও তার পরবর্তী কিছুদিনের মধ্যে নদীয়ার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প, রূপশ্রী ক্যাম্প-সহ অন্যান্য জেলার বিভিন্ন ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের উপর সরকারী অবহেলা ও নিপীড়ন বৃদ্ধি পায়। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য বিধানসভায় সমর মুখার্জী, হেমন্তকুমার বসু, জ্যোতি বসু, মনোরঞ্জন হাজরা প্রমুখ তাদের বক্তব্য তুুলে ধরে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৫৭ সালের ৬ই জুন সমর মুখার্জী বিধানসভায় রাজ্যের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার অভিযোগ আনেন।
সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ অর্থা ইউ. সি. আর. সি. ১৯৫০ সালের ১২ই আগস্ট ইউনিভারসিটি ইনষ্টিট্যুট হলে তাদের সম্মেলন এবং ১৩ই আগস্ট কলকাতার ময়দানে প্রকাশ্য অধিবেশন উপলক্ষে সংগঠনটি বাস্তুহারাদের ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দেয় এবং তাদের বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কথা জানিয়ে তাদের প্রথম ইস্তাহার প্রকাশ করে। এতে উদ্বাস্তুদের প্রতি উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করা হয় যে,
“ভাইসব - বাস্তুহারা সমস্যা বর্ত্তমানে বাংলার তথা সমগ্র ভারতের জাতীয় জীবনের প্রথম ও প্রধান সমস্যা। . . . সরকার চরম ঔদাসীন্য ও বাস্তুহারাদের মধ্যে সঙ্ঘবদ্ধতার অভাব এতদুভয়ের সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ সর্ব্বনাশ ঘটাইতে সমুদ্যত হইয়া উঠিয়াছে। বাস্তুহারাদের বিরুদ্ধে এই দেশব্যাপী নারকীয় ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করিবার জন্য ও লৌহ কঠিন ঐক্যবদ্ধ সংগঠনের ভিত্তিতে বাস্তুহারাদের দাবী আদায়ের উদ্দেশ্যে তীব্র আন্দোলন সৃষ্টির জন্য দলে দলে আসন্ন সম্মেলনে যোগদান করুন। ১১৫, এ আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটে সম্মেলনে প্রস্তুতি কমিটির সম্পাদকের নিকটে প্রতিটি এলাকা, প্রতিটি উদ্বাস্তু শিবির ও উপনিবেশ হইতে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দের নাম ও যথাশক্তি আর্থিক সাহায্য পাঠাইয়া উদ্বাস্তু পুনর্ব্বসতির আন্দোলনকে জয়যুক্ত করুন।”
অম্বিকা চক্রবর্তীর পর ইউ. সি. আর. সি.-র সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় সমরবাবুকে। তিনি দীর্ঘদিন এই পদে থেকে ইউ. সি. আর. সি.-র নদীয়া-সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার, এমনকি দূরদূরান্তের বিভিন্ন রাজ্যের বাঙ্গালী উদ্বাস্তুদের আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং উদ্বাস্তুদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরেন। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার অন্তর্গত বেতাই বাজারটি উচ্ছেদের জন্য পাবলিক ওয়ার্কার্স ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ মামলা করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বেতাই বাজার কমিটির পক্ষ থেকে পরিমল বাগচী ও মনোরঞ্জন ব্যানার্জীকে নিয়ে সমর মুখার্জী ও নিরঞ্জন সেন ২৭শে নভেম্বর বিধানসভা ভবনে তকালীন পূর্তমন্ত্রী খগেন দাশগুপ্তের কাছে একটি স্মারকলিপি তুলে দেন এবং বেতাই বাজার উচ্ছেদ রদ করার দাবি জানান। অবশেষে বেতাই বাজার উচ্ছেদ রদ করা সম্ভব হয়।
নদীয়া জেলায় ইউ. সি. আর. সি. ক্রমে শক্তিশালী হতে থাকে। নদীয়ার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী পল্লী হয়ে ওঠে এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। তাই ইউ. সি. আর. সি.-র প্রথম (১৯৫০ সাল), দ্বিতীয় (১৯৫১ সাল) ও তৃতীয় (১৯৫৫ সাল) সম্মেলন যথাক্রমে কলকাতা বা কলকাতার সন্নিহিত বেলঘরিয়ায় অনুষ্ঠিত হলেও ১৯৫৭ সালে ইউ. সি. আর. সি.-র চতুর্থ সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় নদীয়া জেলার রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে। ফলে নদীয়ার উদ্বাস্তু আন্দোলনের গুরুত্ব অনেক বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী নেতাদের উদ্যোগে যে খাদ্য আন্দোলন শুরু হড় তাতে নদীয়ার উদ্বাস্তুরা ব্যাপকভাবে অংশ নিয়ে আন্দোলনকে গতিশীল করেছিল। কৃষ্ণনগরের খাদ্য আন্দোলনের জমায়েতে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসত রানাঘাট-সহ নদীয়া জেলার বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরগুলি থেকে। নদীয়া থেকে আগত বৃহ উদ্বাস্তু মিছিলের জন্য কলকাতার সমাবেশগুলিতেও খাদ্য আন্দোলনের নেতারা অপেক্ষা করে থাকতেন।১০
এরপর থেকে নদীয়া জেলায় আন্দোলন আরও তীব্রতর হতে থাকে। রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে এই জেলার উদ্বাস্তু আন্দোলন নতুন গতিতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬১ সালের ২রা জুন থেকে ৪ঠা জুন রানাঘাটের রূপশ্রী পল্লীতে ইউ. সি. আর. সি.-র ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সময় নদীয়া জেলা বাস্তুহারা পরিষদের সম্পাদক ছিলেন গৌর কুণ্ডু। রানাঘাটের উল্লেখযোগ্য উদ্বাস্তু নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী  ইউ. সি. আর. সি.-র উক্ত সম্মেলনের জন্য সভাপতি নির্বাচিত হন। তকালীন কংগ্রেস সরকার রানাঘাটের রূপশ্রী পল্লীতে অনুষ্ঠিতব্য ইউ. সি. আর. সি.-র ষষ্ঠ সম্মেলন বানচাল করার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, গৌর কুণ্ডু, সমর মুখার্জী, প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী প্রমুখ উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতাকে ৬০ দিনের ভেতর রানাঘাট ও তার নিকটবর্তী কুপার্স ক্যাম্প, রূপশ্রী ক্যাম্প, নাসরা কলোনী, কীর্তিনগর কলোনী, নোকারি এবং বৈদ্যপুর ইউনিয়ন এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। এরূপ তীব্র দমননীতির ফলে উদ্বাস্তু নেতারা রূপশ্রী পল্লীতে সম্মেলন অনুষ্ঠিত করতে পারেননি। তবে নেতারা সরকারী দমননীতিতে সম্পূর্ণ পিছিয়ে না গিয়ে সম্মেলনের স্থান পরিবর্তন করেন। রানাঘাটে সম্মেলনের যে তারিখ নির্দিষ্ট হয়েছিল তা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়ে ৯ জুন থেকে ১১ জুন ২৪ পরগণা জেলার সোদপুরের ‘তীর্থ ভারতী’তে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।১০
ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে সরকারী ডোল বন্ধ ও বহু উদ্বাস্তুকে উচ্ছেদের নোটিশ দেওয়া হলে নদীয়ার রানাঘাটের উদ্বাস্তু আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। নদীয়ার বামপন্থী নেতা তথা নদীয়া জেলার বাস্তুহারা সমিতির সম্পাদক আইনজীবী গৌর কুণ্ডু রানাঘাটের বিভিন্ন ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর নেতৃত্বে কুপার্স ক্যাম্প ও রূপশ্রী ক্যাম্পের উদ্বাস্তুরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ফলে সরকার ২৫শে এপ্রিল, ১৯৬১ তারিখে গৌর কুণ্ডু সহ ১৪ জন উদ্বাস্তু আন্দোলনকারীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের খোঁজে এবং ক্যাম্পের উদ্বাস্তুদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করার জন্য পুলিশ কুপার্স ক্যাম্পের বাড়ি বাড়ি হানা দেয়। ২৬শে জুন দমদমের নিকটবর্তী বাগজোলা ক্যাম্পে পুলিশ গুলি চালিয়ে একটি শিশুসহ পাঁচজন উদ্বাস্তুকে হত্যা করে।১১ এই খবর পেয়ে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নদীয়ার রানাঘাটের উদ্বাস্তু নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিতে দেখতে যান। নদীয়ার সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী ছিলেন তখন ইউ. সি. আর. সি.-র রাজ্য সভাপতি।১২
ইতিমধ্যে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের দাবি ও আন্দোলনের ফলে তকালীন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ১৯৫৯ সালের ১৩ই এপ্রিল Rehabilitation Industries Corporation বা সংক্ষেপে আর. আই. সি. গঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের R. R. & R. Department-এর যে ক্ষেত্রগুলি উদ্বাস্তুদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হয়েছিল তা কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইন্দিরা গান্ধীর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে ১৯৮০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই সংস্থাটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এই উদ্দেশ্যে কয়েকটি শিল্প ইউনিট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যার মধ্যে নদীয়া জেলায় ছিল তিনটি তাঁত শিল্প ইউনিট। সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল করার দাবিতে বিভিন্ন উদ্বাস্তু আর. আই. সি.-র হেড অফিসের সামনে ৫৫ দিন অবস্থান করে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হস্তক্ষেপে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। অবশ্য পরে ১৯৮৪ সালের ৬ই এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর এই মন্ত্রীসভাই আর. আই. সি. সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এবারও উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা সমর মুখার্জী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সরকারের এই সিদ্ধান্তের উপর স্থগিতাদেশ আদায় করতে সক্ষম হন।১৩

তবে নদীয়া জেলায় উদ্বাস্তু আন্দোলনের জয় হোক বা না হোক, এই জেলায় অবশ্যই উদ্বাস্তুদের জীবন-যুদ্ধের জয় হয়েছে। অনাহুত, অবাঞ্ছিত হয়ে নদীয়ায় এসে তারা একদিকে ভোগ করেছে চরম আর্থিক অভাব-অনটন, অন্যদিকে স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে ক্রমাগত ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অপমান, অবজ্ঞা, ঘৃণা, প্রতারণা ইত্যাদি। এই সবকিছুর বিরুদ্ধেই বাস্তুহারাদের অবিরাম লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। ফুটপাত, প্লাটফর্ম, উদ্বাস্তু শিবির প্রভৃতি স্থান থেকে যে জনসমাজের অধিকাংশ মানুষের পথ চলা শুরু তারা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে হেরে যায়নি। ‘অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামে’ তারা অবশেষে জয়ী হয়েছেন। তাদের অদম্য চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন উদ্বাস্তু কলোনী, স্কুল, বাজার, সমবায় সমিতি, ক্লাব, রাস্তাঘাট, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ইত্যাদি। নদীয়ার গ্রামের বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠগুলি তারা কোলাহলে ভরিয়ে তুলেছেন। উদ্বাস্তু সমাজকে তার মূল স্রোতের অঙ্গীভূত করে নদীয়া জেলা ক্রমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে।

3 comments:

  1. সমৃদ্ধ হলাম ....#স্যার

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ অবদান স্যার।

    ReplyDelete
  3. দুষ্প্রাপ্য নথি

    ReplyDelete