রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সক্রিয়তা : প্রসঙ্গ স্বদেশি আন্দোলন
- স্বাতী মৈত্র,
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা।
==============================================
বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিস্তার ছিল সর্বব্যাপী। সাহিত্য, শিল্পকলা, ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, রাজনীতি, দর্শন- কিছুই তাঁর চিন্তার বিষয় থেকে বাদ যায়নি। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, শিল্পী ও শিক্ষাবিদ। তিনি এক হাজারের মতো কবিতা ও দুই হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন এবং অন্ততঃ তিন হাজার ছবিও এঁকেছেন। এগুলির অধিকাংশই তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরের সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যাণ্ড্রু রোবিনসন উল্লেখ করেছেন যে, যুব (Rabindranath) was not an analytical thinker, always an intuitive one who preferred a poetic analogy to a prosaic argument." সেজন্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের ঘটনা তাঁর একটি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচিতি হল তিনি একজন কবি। একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতির উর্দ্ধে তাঁর মনকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতির ক্ষতিকারণ দিকটি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই প্রথম দিকে রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তিনি মনে করতেন যে, রাজনীতি সকল দেশেই নৈতিকতার অবনমন ঘটিয়েছে এবং রাজনীতির ফলেই মিথ্যা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা ও কপটতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-ভাবনা পরবর্তীকালে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কেননা, একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহী হলেও তিনি যেমন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছেন তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থনেও এগিয়ে এসেছেন। ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ভারতের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আসে। তবে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের পর রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সমগ্র বিশ্ববাসীর নজর আকৃষ্ট হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তার দ্বারা ইউরোপের সর্বাধিক নজর আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। তাছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রচিত ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ইউরোপের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের স্বেচ্ছাচারী নীতির অন্যতম প্রধান রূপকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়। এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন সংগঠিত হয়। আপাতভাবে কার্জন বৃহৎ বঙ্গ বিভাজনের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এই বঙ্গবিভাগের নেপথ্যে ছিল বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে কার্জনের কুচক্রী উদ্দেশ্য। বাঙ্গালী জাতি ছিল ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে দ্বিখণ্ডিত ও দুর্বল করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়াই ছিল কার্জনের মূল উদ্দেশ্য। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালী জাতি ইংরেজদের এই চক্রান্তকে সমূলে উৎখাৎ করার জন্য স্বদেশি আন্দোলনে সামিল হয়েছিল।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলন কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছিল তা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এই আলোচনার মূল বিষয় হল“রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক আদর্শায়িত গণপ্রতিরোধের চিত্র যা বাংলার নরনারীকে, জাতিকে আনার চেষ্টা করেছিল বাংলা-হৃদয় মঞ্চে।” স্বদেশি আন্দোলনের শেষ পর্বে (১৯১০ সালে) রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে গোরা একবার ত্রিবেণীসঙ্গমে অগণিত ভারতীয়র সঙ্গে একঘাটে স্নান করে সমগ্র ভারতকে নিজের অন্তরে অনুভব করতে চেয়েছিল। সেখানে গোরার চিন্তায় কাজ করেছিল জাতীয়তাবোধ। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালীর হৃদয়ে সেই জাতীয়তাবোধেরই বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথ গোরার মতো খ-িত ভারতবর্ষের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন না। তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র জাতির আন্দোলনকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাখি বন্ধন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে একতা নির্মাণের পথে।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলন পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থে ‘স্বদেশি’ বলতে বোঝায় ‘নিজের দেশের’। বিলাতী দ্রব্য বর্জন বা বয়কট করে দেশিয় দ্রব্যসামগ্রি ক্রয় করাই ছিল এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কথা। আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল- এদেশে বিলাতী দ্রব্য বর্জন করলে ব্রিটিশরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে পরবে তেমনি দেশিয় দ্রব্য বিক্রি বৃদ্ধি পেলে দেশিয় শিল্প ও অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে।
তবে বলপ্রয়োগ করে বিলাতী দ্রব্যসামগ্রী বয়কট বা বর্জন করার প্রয়াস শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ তা সমর্থন করেননি। “কারণ, তিনি বুঝেছিলেন এই প্রয়াস ছিল রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত। এতে বাস্তবসম্মত বোধের অভাব ছিল।” তিনি মনে করতেন যে, শুধুমাত্র বয়কটের দ্বারা বঙ্গীয় সমাজের মূল সমস্যাটিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনে তাঁর লক্ষ্য ছিল যে, মূল স্বদেশির আদর্শ জাতীয় সুপ্ত চেতনার দরজায় আঘাত হানবে আর সেই জাগ্রত চেতনার ফলে তাঁতি শুধু কাজ পাবে না- অনাথ শুধু ত্রাণ পাবে না- তা ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের, জমিদার ও কৃষকের, হিন্দু ও মুসলমানের, ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের অবসান ঘটাবে। কংগ্রেস দলের নেতারা যখন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করলেও জার্মান, অষ্ট্রিয়া বা আমেরিকার পণ্য ব্যবহারে কুণ্ঠাবোধ করেননি তখন স্বদেশিকতার নামে নেতাদের বিভ্রান্তিমূলক নীতির সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কালান্তর’ পত্রিকায় লিখলেন-
“বস্তুত যখন সমগ্রভাবে দেশের বুদ্ধিশক্তি, কর্মশক্তি উদ্যত থাকে তখন অন্যদেশ থেকে কাপড় কিনে পড়লেও স্বরাজের মূলে আঘাত লাগে না। গাছের গোড়ায় বিদেশি সার দিলে গাছ বিদেশি হয় না।” বা “খদ্দর পরা দেশই যে সমগ্র দেশের সম্পূর্ণ আদর্শ একথা আমি কোন মতেই মানতে পারি নে।”
একদা রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা ক্রমশ ভিন্নপথে প্রবাহিত হতে থাকে। তিনি বলেন যে, রাজনীতি তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ হলেও তিনি যে দেশে, যে পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আবর্তে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে যখন স্বদেশি আন্দোলন শুরু হল তখন রবীন্দ্রনাথ শীঘ্রই তাতে জড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রচারিত হলে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে (২২ জুলাই) ‘স্বদেশি সমাজ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি বঙ্গভঙ্গের মূল সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং কীভাবে এর প্রতিকার সম্ভব তার-ও ব্যাখ্যা দেন। তিনি গণ স্বাক্ষর সম্বলিত তীব্র কটাক্ষপূর্ণ 'Memorial' ইংরেজ রাজদরবারে পাঠান। ১৯০৫ সালে কার্জন দুই বাংলা বিভক্ত করলে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন প্রসঙ্গে স্বদেশি গান লিখতে, বক্তব্য রাখতে এবং গণ মিছিলে অংশ নিতে শুরু করলেন। স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসাবে তিনি একটি দেশলাই কারখানা, একটি ব্যাঙ্ক এবং একটি তাঁতশিল্প কেন্দ্র স্থাপন করেন। আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি ১২টি স্বদেশি সঙ্গীত রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ ইত্যাদি। এভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্নভাবে নেতৃত্বদান করেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ থাকলেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলন ছিল এমনই একটি রাজনৈতিক বিষয় যার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রবীন্দ্রনাথের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল।
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যেদিন কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে দ্বিখ-িত করেন, সেদিন এর প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ‘রাখিবন্ধন’ উৎসবের সূচনা করেন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের অস্ত্র চালনার দ্বারা দুই বাংলা বিভাজিত হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় বাঙ্গালী ভাইবোনেরা একে অপরের হাতে রাখি বেধে মনের অখ-তা প্রকাশ করে। তাঁর প্রেরণায় হাজার হাজার মানুষ গঙ্গার ধারে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে মিছিল করে শহর পরিক্রমা করে। হিন্দু ও মুসলিম ভাইবোনেরা সৌভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেয়। দুই বাংলার মানুষের মনোজগতের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে রাখিবন্ধনের উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান-
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,
পুণ্য হউক, হে ভগবান।
প্রথমদিকে স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা ছিল অহিংস ও অসহযোগ। কিন্তু যখন কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা অহিংস অসহযোগের পথ পরিহার করে আন্দোলনকে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী পথে পরিচালিত করেন তখন রবীন্দ্রনাথ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যারা আপাতভাবে নিরীহ এবং এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন, তাদের যখন জোর করে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তিনি প্রমাদ গণেন। রবীন্দ্রনাথের আন্দোলন এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধেও। তিনি মনে করেন যে, যে ব্যক্তির ধর্ম অন্যের ধর্মকে অবজ্ঞা করতে শেখায়, যার সবকিছুই প্রতিবেশির স্পর্শে অপবিত্র হয়ে যায়, অন্যের ধর্মের অবমাননা করেই যার পবিত্রতা রক্ষা করতে হয় সেই ব্যক্তি অবমাননারই যোগ্য। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের এই কুৎসিত দিকগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে গঠনমূলক স্বদেশির প্রচার হোক। সমাজে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি চেয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগগুলি উপলব্ধি করুক। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চরমপন্থী ও নরমপন্থী আদর্শের বিরোধ ও বাড়াবাড়িকে বা বাইরে থেকে আন্দোলনের মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়াকেও সমর্থন করেননি। তাছাড়া তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, আন্দোলনে ক্রমে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম সমাজকে আন্দোলন থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। তাই মুসলিমদের অনেকেই মনে করতেন যে, এটি আসলে হিন্দুদের আন্দোলন। তাই তারা এই আন্দোলনে আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি। তাছাড়া আন্দোলনের সময় এক শ্রেণির পুনরুজ্জীবনবাদীর উদ্যোগে সমাজে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি পায়। কিছু জাতীয়তাবাদী নেতার উৎসাহে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পরিণতিতে ১৯০৬ সালের মে মাস থেকে ১৯০৭ সালের মে মাসের মধ্যে পূর্ববঙ্গে বেশ কয়েক স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে যায়।
এরপর আন্দোলন ক্রমে সন্ত্রাসবাদী পথে অগ্রসর হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বসু বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ দুই ইংরেজকে হত্যা করেন। অহিংস অসহযোগ থেকে আন্দোলন ক্রমে সহিংস আগ্রাসী পন্থায় পরিচালিত হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তিনি তাঁর বহু স্বদেশবাসীর বিভিন্ন সমালোচনার শিকার হন। সমালোচকদের কেউ কেউ আবার তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী বলে বিদ্রুপ করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করলেন। স্বদেশি আন্দোলনে মোহভঙ্গ হওয়ার পর থেকে তিনি আর কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত করেননি।
স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বাধিক পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে শুধু সমকালীন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করেছেন তা-ই নয়, এটিই হল ‘সাধু ভাষা’ পরিত্যাগ করে ‘চলিত’ বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ফলে তখন থেকেই সংস্কৃত-প্রেমী পণ্ডিতমহল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ "The Home and the World" প্রকাশিত হলে ইউরোপেও এর ব্যাপক সাড়া পড়ে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিখিল, বিমলা ও সন্দীপের চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। নিখিলের চরিত্রে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির ছায়াই দেখতে পাওয়া যায়। উপন্যাসের নিখিল একজন সদয়, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল জমিদার। তার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মানসিকতা নেই, আছে দেশপ্রেম। নিখিলের বন্ধু সন্দীপ ছিল স্বার্থপর এবং স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা হিসাবে চরমপন্থার উগ্র সমর্থক। জাতীয়তাবাদী সন্দীপের নীতিকে নিখিল সমর্থন করেনি। নিখিল ও সন্দীপের পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ফাঁপরে পড়ে যায় নিখিলের স্ত্রী বিমলা। আবেগতাড়িত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে গিয়ে নিখিল ক্রমে সামগ্রিক পরিস্থিতি, এমনকি তার স্ত্রী বিমলার কাছ থেকেও একাকী হয়ে পড়ে। বিমলা ক্রমে সন্দীপের ক্যারিশ্মাটিক ব্যক্তিতে আকৃষ্ট হতে থাকে। স্বদেশি আন্দোলনের নামে সন্দীপ যখন গ্রামের দরিদ্র ও নিরীহ বাসিন্দাদের স্বদেশি দ্রব্যসামগ্রি কেনার জন্য বলপ্রয়োগ শুরু করে তখন নিখিল তাতে সায় দেয়নি। কেননা, স্বদেশি জিনিসপত্রের মূল্য যেমন বিলাতী দ্রব্যের চেয়ে বেশি তেমনি দ্রব্যের গুণগত মান ল্যাঙ্কাশায়ার বা ম্যানচেস্টারে উৎপাদিত দ্রব্যের চেয়ে কম। বাংলার দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে বিলাতী দ্রব্যেরই বেশি প্রয়োজন ছিল। যখন এই দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের উপর ‘স্বদেশির’ নাম করে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বলপ্রয়োগ শুরু করলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমে আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকলেন। তিনি ১৯০৮ সালে প্রকাশিক ‘সদুপায়’ নামে এক প্রবন্ধে একজন বাঙ্গালী হিসাবে আত্মসমালোচনা করে উল্লেখ করলেন যে, আমাদের দুর্ভাগ্যই হল- আমরা স্বাধীনতা চাইলেও আমরা অন্তর থেকে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করিনা।
নিখিল উপলব্ধি করেছিল যে, বিলাতী দ্রব্য জোর করে বয়কট করলে দেশের দরিদ্র মানুষেরই সবচেয়ে ক্ষতি হবে। কিন্তু নিখিলের প্রতিবাদ সন্দীপের বেপরোয়া চরম দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। সন্দীপের এই বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ক্রমশ খারাপ পথে নিয়ে যেতে থাকে। সে তার বন্ধু নিখিলের স্ত্রীর সঙ্গেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। একজন মুসলিম মাঝি যখন তার উপার্জন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় স্বদেশিদের নির্দেশ উপেক্ষা করে তার নৌকায় বিলাতী পণ্য পরিবহন অব্যহত রাখে তখন সন্দীপ সেই দরিদ্র মুসলিম মাঝিটির নৌকা জলে ডুবিয়ে দিতে তার একজন অনুগামীকে নিদের্শ দেয়। সন্দীপ তার অনুগামীদের মুসলিম-বিদ্বেষী করে তোলে এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে উদ্দীপ্ত করে। আর নিখিল এই দাঙ্গা প্রশমিত করতে গিয়ে দাঙ্গাতেই তার মৃত্যু হয়। বেপরোয়া সন্দীপের কর্মকা- এবং আদর্শবাদী ও মানবিক নিখিলের চরিত্রের মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আন্দোলনের নামে কীভাবে নৈতিকতার মৃত্যু ঘটছে তা নিখিলের মৃত্যুতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে চিত্রিত নিখিলের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাঙ্গালী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রকাশ করে। সন্দীপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিখিলের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তৎকালীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টিকেই প্রকাশ করে। স্বদেশি আন্দোলন পরিচালনার পন্থায় তাঁর মোহভঙ্গের বিষয়টি শুধু সাহিত্যে নয়, জাপান ও ব্রিটেনে ১৯১৬-১৭ সালে প্রদত্ত তাঁর বেশ কিছু বক্তৃতায়ও তাঁর এই মোহভঙ্গের বিষয়টি উঠে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সমকালীন সময়ে বিদ্রুপের শিকার হলেও পরবর্তীকালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর রাজনৈতিক পন্থাই সর্বাধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে তাঁর চিন্তিত অহিংস ও অসহযোগ পন্থাই ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের পন্থা হিসাবে গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ও পরিচালনায় অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন সারা দেশের আন্দোলনে তীব্র জোয়ার আনে। স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের পন্থাই গান্ধীজী তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনে সর্বাধিক প্রয়োগ করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থাকে গান্থীজী তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পূর্বসূরী বরে অভিহিত করা যেতে পারে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়বাদী ও সহাবস্থানের মহান আদর্শ প্রতিটি দেশে, প্রতিটি যুগেই অনুকরণীয় হতে পারে। বর্তমান উন্মত্ত ও হিংসা-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ আরও বেশি করে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
সূত্র নির্দেশ ঃ
১। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’।
২। Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis: Tapati Dasgupta
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কালান্তর’।
৫। Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
৬। http:/ww/w.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html : Uma Das Gupta, Anandarup Ray
৭। http:/ww/w.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh
General References:
1|
cÖfvZKzgvi
gy‡Lvcva¨vq, Ôiex›`ª RxebK_vÕ|
2|
Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis:
Tapati Dasgupta
4|
Selected letters of Rabindranath Tagore: Edited by Krishna Dutta,
Andrew Robinson
5|
Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
6|
http://www.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html
: Uma Das Gupta, Anandarup Ray
7|
http://www.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh
https://www.digitaltechgaming.xyz/
ReplyDeleteMerkur 34C Classic | OC | XN-O802021
ReplyDeleteBuy Merkur 34C Classic Online at XN-O802021. The online shopping platform is a new online shopping platform that enables you to 샌즈카지노 shop with 메리트카지노 a wide selection 메리트카지노총판