রবীন্দ্র চেতনায় অখন্ড ভারত
ড. সঞ্জয় প্রামাণিক
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর,
বাংলা বিভাগ,
বাংলা বিভাগ,
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ।
বিশ্বের মানব সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরেছেন সৃষ্টি-কর্মের মাধ্যমে। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি একজন দেশপ্রেমিক হিসাবেও তিনি আমাদের কাছে পরিচিত। তাঁর চেতনায় দেশপ্রেম মানে খণ্ডিত ভারত নয়, অখণ্ডিত ঐক্যবদ্ধ ভারত। তিনি কেবল ভারতের কবি নন, সমগ্র বিশ্বের। তাঁর কর্ম, ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে যেমন ছিল সৃষ্টিশীল প্রতিভার চুড়ান্ত নিদর্শন, তেমনি জীবন-কর্মের মধ্যেও ছিল সম্ভবনার চুড়ান্ত ইঙ্গিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন এবং অখণ্ড। কিন্তু এমন এক সময় এল যখন ভারতবর্ষ খণ্ডিত হওয়ার মুখে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন; করেছিলেন রাখী বন্ধন উৎসব, রচনা করেছিলেন স্বদেশ প্রেমমূলক গান, ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছিলেন সকল সম্প্রদায়কে। এর মধ্যে কবির স্বদেশ ভাবনার পূর্ণ প্রতিফলন পাওয়া যায়, পাওয়া যায় স্বদেশ প্রেমের কথাও।
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
হে ভগবান।’
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
হে ভগবান।’
এই স্বদেশ প্রেম মূলক গান গাইতে গাইতে গঙ্গার ঘাটে স্নান করে একে অপরের হাতে
রাখি পরিয়ে মিলনোৎসব পালন করলেন। এবং ফেরার পথে এক
আস্তাবলে প্রবেশ করে মুসলিম ভাইদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃত্বের, প্রেমের
বন্ধনে মিলিত হলেন। এই মিলনোৎসব চিতপুরের বড়ো মসজিদের মৌলবিরা হাসি মুখে মেনে নিয়ে
অভ্যর্থনা জানালেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাদেশিকতার ও অখণ্ড ভারত প্রেমের
বড় পরিচয় পাওয়া যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ
ভাবনা কেবল বাংলাকে ঘিরে নয়; সমগ্র অখণ্ড ভারতকে ঘিরে। অখণ্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান তথা বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলনের কথা ভেবেছিলেন। কারণ মিলনই মানুষে
মানুষে ঐক সাধন করে। তাই তিনি বলেছিলেন,- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন-
শক-হুন-দল পাঠান মোঘল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’
অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষকে সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র রূপে দেখেছিলেন। কবির আশা ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য
উভয় দেশের সভ্যতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাগরতীরের এই উপমহাদেশ মহাতীর্থে পরিণত
হবে। কিন্তু দেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে প্রত্যক্ষ করে তিনি মর্মাহত এবং
ব্যথিত হয়ে বলেছিলেন,- ‘...হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই
দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে
এরা নিজ নিজ ধর্ম-দ্বারাই পরস্পরকেও জগতের অন্যান্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলিয়া
রাখে।’ ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই কবি ধর্মের পরিবর্তে মানবধর্মের কথা বলেছেন; যে মানবধর্ম
মানবতা জাগাতে পারে; মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পারে। ‘লোকহিত’
প্রবন্ধে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অভাবের কথা বলেছেন। সেখানে
তিনি বলেছেন,- স্বদেশিযুগে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল আরোপিত বা
অভিনয়ের মত। মুসলমান, হিন্দু ভাইদের আহ্বানে উদ্বেলিত হয়নি। কারণ উভয় সম্প্রদায়ের
মধ্যে বিভেদ বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। তাই হিন্দু স্বদেশী প্রচারক জল পানের সময় মুসলমান
প্রতিবেশীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলে। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র এই
বেআব্রু ভাব ছিল। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্মতা গড়ে ওঠেনি। এতে বঙ্গভঙ্গ আরও
সহজতর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝেছিলেন বঙ্গভঙ্গ রোধ করা যাবে না, যদি
ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করা না যায়। সেই কারণেই তিনি ‘রাখি’ বন্ধন উৎসবের মধ্য
দিয়ে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে প্রীতিমূলক ও আন্তরিক করতে
চেয়েছিলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ছিল অখণ্ড ভারত প্রেম। কেবল হিন্দু-মুসলমান
নয়, সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র হয়ে অখণ্ড ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক এক পুণ্যভূমি।
‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য গ্রন্থের ১০৬ সংখ্যক কবিতায় তিনি সে কথা বলেছেন,-
“এসো হে আর্য,
এসো অনার্য
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত
করো অপনীত
সব অপমানভার।”
এখানে কবির স্বদেশ প্রেম
কেবল দেশবাসীকে নিয়ে নয়; আগত, অনাগত সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে অখণ্ড মানব প্রেম। এই
প্রেমই উত্তীর্ণ হয়েছে বিশ্বপ্রেমে।
ঋষিকল্প মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অখণ্ড ভারতবর্ষের রূপ-সৌন্দর্য
কল্পনার সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেই সাধনার মন্ত্র দিয়েই বিশ্বমায়ের স্নেহের আঁচলের
সন্ধান পেয়েছেন। এখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ব্যক্তি মায়ের তুলনায় দেশমাতৃকাকে তিনি কম সম্মান
করেননি। সেই সম্মান রক্ষার জন্য গাইলেন-
“ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে
বিশ্বময়ীর
তোমাতে বিশ্বমায়ের
আঁচল পাতা!”
লক্ষ্যণীয় এই গীত-মন্ত্রের মধ্যে আছে কবির সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা বাংলার
মাটির কথা; আছে বিশ্বপ্রেমের প্রসঙ্গও। এখানে কবি মননের অখণ্ড ভারতপ্রেম প্রসারিত
হয়েছে বিশ্বপ্রেমে। এই প্রসারিত বিশ্বপ্রেমের উৎস বাংলাকে ঘিরেই। বাংলার হৃদয় ভারতের সঙ্গে
মিশে গেছে। এই কথা ভেবে কবি গেয়ে ঊঠলেন,-
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির
হলে জননী!”
এ সঙ্গীতে কেবল স্বদেশ প্রেমই নেয়; ভারতবর্ষের মর্মবস্তুর হৃদস্পন্দনের ধ্বনিও
অনুভূত হয়েছে। কবি এই ভাবেই স্বাদেশিকতার অনুশীলন করে নিজেকে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমিক রপে
প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশকে পুণ্যভূমি বলেছেন। তাই কবির ঋষিকণ্ঠে আবার পুণ্যবাণী উচ্চারিত হয়েছে,-
‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থ
জাগোরে ধীরে
এই ভারতের
মহামানবের সাগরতীরে...’।
অর্থাৎ ভারতবর্ষকে পুণ্যতীর্থ ভাবা স্বদেশ ভাবনারই ফল। আসলে কবি স্বদেশ ভাবনার
ধারনাকে সংস্কার করেছেন। তাঁর স্বদেশ ভাবনা ভৌগোলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা কিম্বা
ভাষভিত্তিক ঘেরাটোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। তা ছিল নিঃস্বার্থ-মানবতাবাদের
প্রকাশ। আসলে কবি অন্ধ স্বদেশ প্রেমিক ছিলেন না বা সংকীর্ণতাও তাঁর মধ্যে ছিলনা;
ছিল উদার এবং মানবতা জাগরণের উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতেই গোরা সত্য সন্ধানী হয়েছে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সন্দীপের মধ্যে আদর্শ ও নিষ্ঠা ততটা
ছিলনা, তবে ছিল সূক্ষ্ম বিচার বোধ। আর গোরার স্বদেশ প্রেম ছিল স্নিগ্ধ ও শুচিশুভ্র
সুন্দর। আচার নিষ্ঠা হলেও তার মধ্যে ছিলনা কোন ফাঁকি। সেই কারণেই গোরা মিথ্যাকে
ছেড়ে সত্যকে লাভ করতে চেয়েছে। এবং আনন্দময়ীকে বলেছে,- ‘মা, তুমিই আমার মা। … তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই-শুধু তুমি কল্যাণের
প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ’। ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গোরা’ উপন্যাস দুটির মধ্যে স্বদেশ চেতনার
যে রূপ পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথের বস্তুগত দৃষ্টির পরিচয় দেয়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর এখানে কেবল দেশ প্রেমিকই নন। তিনি একজন ভারত দ্রষ্ট্রাও বটে। এই ভারত
দ্রষ্টার আরও দৃষ্টান্ত আছে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ‘অনুশীলন সমিতি’র মাঠে গাওয়া
গানে,- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এ গান কবির একার
নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। অর্থাৎ সমগ্র দেশ বাসীর মনে প্রবেশ করাতে
চেয়েছিলেন ‘ভারত মাতা’ কোন বিশেষ জাতির নয়, সকল ভারতবাসীর। এখানে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের স্বদেশিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই
স্বদেশ প্রেমিক যখন বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’ তখন তার মধ্যে একজন ভারত
দ্রষ্টাকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ দেশ প্রেমিককে সর্বোপরি একজন স্বাদেশিককে সকল রকম বাঁধা
মুক্ত হতে হবে। সঙ্গ না পেলে একলা চলতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ব্যক্তি জীবনে যেমন স্বাদেশিক ছিলেন। তেমনি সাহিত্য, সঙ্গীতেও স্বাদেশিকতার
পরিচয় দিয়েছেন। দেশবাসীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের কাছে চিরকাল যেমন
সাহিত্যিক, তেমনি দেশ-প্রেমিক মহান মানব ব্যক্তিত্ব। বঙ্কিমচন্দ্রের
‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসেও দেশের জন্য সংগ্রামের কথা পাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সংগ্রাম
বিশ্বপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-প্রেম বিশ্বপ্রেমে
উত্তীর্ণ হয়ে মানব কল্যানের কথা বলেছে। এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্ন্তজাতিকতার স্তরে উন্নীত
হয়েছেন। তাই এখানে আর সাধারণ ধর্ম চিন্তার কথা নেই, আছে মানব ধর্মের কথা,
মহামানবত্বের কথা।
**********
সহায়ক গ্রন্থ :
১) পশ্চিমবঙ্গ (রবীন্দ্র
সংখ্যা); তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ; ৩১ বর্ষ, ৪১-৪৬ সংখ্যা।
২) রবীন্দ্র–প্রতিভার
পরিচয়; ড. ক্ষুদিরাম দাস; মল্লিক ব্রাদার্স; সেপ্টেম্বর ২০০২।
৩) রবীন্দ্র–রচনাবলী, সুলভ সংস্করণ (১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ,
১২শ খণ্ড); বিশ্বভারতী।
অসাধারণ লেখা, আপনি এমনি লিখে চলুন। আমরা আপনার লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হই।
ReplyDelete