Friday, 2 June 2023

মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও। - সুভাষ বিশ্বাস। Muhammad Ghuri's expedition to India. - Subhas Biswas.

 

===========================================================
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।
- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
===========================================================

Muhammad Ghuri's expedition to India.
- ‍Subhas Biswas,
Dept. of History,
University of Kalyani





==================================================

প্রশ্ন: মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।

উত্তর:

ভূমিকা: 
আফগানিস্তানের ঘুর সাম্রাজ্যের সুলতান মুইজউদ্দিন মহম্মদ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। ইতিহাসে তিনি মহম্মদ ঘুরি নামেই অধিক পরিচিত। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও সাম্রাজ্যবাদী শাসক মহম্মদ ঘুরি 1173 খ্রিস্টাব্দে গজনী রাজ্য জয় করে সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ভারত অভিযানে মন দেন। 

1. উৎস: 
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ পাওয়া যায় চাঁদ বরদই রচিত ‘পৃথ্বীরাজরাসো’, হাসান নিজামি রচিত ‘তাজ-উল-মাসির’, মিনহাসউদ্দিন সিরাজ রচিত ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরি’ এবং ফেরিস্তা রচিত ‘তারিখ-ই-ফেরিস্তা’ প্রভৃতি গ্রন্থে। 

2. ভারত অভিযানের উদ্দেশ্য: 
অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, সুলতান মামুদের মতো ভারতের প্রবল ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদ দ্বারা মহম্মদ ঘুরি প্রলুব্ধ হলেও ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠাই ঘুরির প্রধান লক্ষ্য ছিল। তিনি সীমাহীন ক্ষমতা ও মর্যাদা প্রাপ্তির লক্ষ্যে ভারত আক্রমণ করেন। তবে কোনো প্রকার ধর্মীয় ভাবাবেগ এক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না। অনেকের মতে, খোয়ারিজম সাম্রাজ্যের শাসকদের আক্রমণ থেকে মুক্ত হতেই তিনি ভারত আক্রমণ করেন। 

3. ঘুরির ভারত অভিযানের বিবরণ: 
নীচে মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল— 

a. মহম্মদ ঘুরি 1175 খ্রিস্টাব্দে কার্মাথিয়ান বংশীয় শাসকদের পরাজিত করে মুলতান জয় করেন। ওই বছরই তিনি সিন্ধুর উচ্‌ অঞ্চল জয় করেন। 
b. তিনি 1178 খ্রিস্টাব্দে গুজরাট দখলের চেষ্টা করলেও বাখেলা বংশীয় রাজা ভীমদেবের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন। 
c. তিনি 1179 খ্রিস্টাব্দে পেশোয়ার এবং 1185 খ্রিস্টাব্দে শিয়ালকোট দখল করেন। এরপর 1186 খ্রিস্টাব্দে লাহোরের গজনভি রাজ্যের শাসক খুসরু মালিককে পরাজিত করে তিনি লাহোর দখল করেন। এভাবে সমগ্র পাঞ্জাবে ঘুরির আধিপত্য কায়েম হয়। 
d. মহম্মদ ঘুরি 1191 খ্রিস্টাব্দে দিল্লি ও আজমিরের চৌহান বংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এটি ‘তরাইনের প্রথম যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে কনৌজ-রাজ জয়চাঁদ ছাড়া উত্তর ভারতের সকল রাজপুত রাজারা পৃথ্বীরাজ চৌহানকে সমর্থন করেন। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্বে মহম্মদ ঘুরি ভাতিন্ডা নামক অঞ্চলটি দখল করেন। কিন্তু যুদ্ধের অন্তিম পর্বে পৃথ্বীরাজের নেতৃত্বে সম্মিলিত রাজপুত বাহিনীর আক্রমণে ঘুরির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। এরপর ঘুরি কোনোক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গজনীতে পৌঁছান। 
e. মহম্মদ ঘুরি 1192 খ্রিস্টাব্দে পুনরায় শক্তি সংগ্রহ করে তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এটি ‘তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে প্রায় 1 লক্ষ 20 হাজার তুর্কি সৈন্য নিয়ে ঘুরি পৃথ্বীরাজকে আক্রমণ করেন। তুর্কি অশ্বারোহী ও তীরন্দাজ বাহিনীর প্রবল আক্রমণের সম্মুখীন হয়ে রাজপুত বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিনহাজ-উস-সিরাজ লিখেছেন, ‘যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে বন্দি করা হয় এবং পরবর্তীতে হত্যা করা হয়।’ এই যুদ্ধ জয়ের পর ঘুরি দিল্লি ও আজমির দখল করেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বার্ষিক করদানের বিনিময়ে পৃথ্বীরাজের এক পুত্রকে মহম্মদ ঘুরি আজমিরের শাসকপদে বহাল রাখেন। এরপর কুতুবউদ্দিন আইবক নামে এক বিশ্বস্ত সেনাপতির হাতে ভারতীয় সাম্রাজ্যের শাসনভার দিয়ে ঘুরি স্বদেশে ফিরে যান। 

4. উপসংহার: 
মহম্মদ ঘুরির ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতে তুর্কী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করা। তাই সুলতান মামুদের মতো ঘুরি কেবল ধনসম্পদ লুণ্ঠনের দিকে নজর দেননি। বরং তিনি তাঁর বিজিত সাম্রাজ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবেই ঘুরির অভিযানের মাধ্যমে ভারতে ইসলামি শাসনের সূত্রপাত হয়। ঐতিহাসিক শ্রীবাস্তব বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন ভারতে তুর্কি সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।’ তবে ভারতীয় শাসকদের সামরিক দুর্বলতা ও ঐক্যের অভাবই যে ঘুরির ভারত অভিযানকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিবরণ। Sultan Mamud's expedition to India.

 

===================================

সুলতান মামুদের ভারত অভিযানের বিবরণ দাও।

- সুভাষ বিশ্বাস,
ইতিহাস বিভাগ,
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

===================================

Sultan Mamud's expedition to India.

ভূমিকা: মামুদের পিতা সুলতান সবুক্তগীন একাধিকবার ভারত আক্রমণ করেও ব্যর্থ হন। তাঁর মৃত্যুর (997 খ্রি.) পর তাঁর পুত্র মামুদ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইসমাইলকে পরাস্ত করে গজনীর সিংহাসনে বসেন (998 খ্রি.)। তাঁর কর্মদক্ষতায় মুদ্ধ হয়ে খলিফা তাঁকে ‘ইয়ামিন উল্লাহ’ উপাধি দেন। এজন্য তাঁর বংশের নাম হয় ‘ইয়ামিন বংশ’। মামুদ 1000-1027 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মোট সতেরো বার ভারত অভিযান করেন। গজনীর সুলতান মামুদের ভারত অভিযান ছিল ইতিহাসের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। 1. ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্য: অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, ভারতের অপরিমিত ঐশ্বর্য ও ধনসম্পদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সুলতান মামুদ বারংবার ভারত আক্রমণ করেন। মহম্মদ হাবিব তাঁর ‘Mahmud of ghazni’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “মামুদ কোনো ধর্মপ্রচার করেননি, ধর্মান্তর করাও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না।” মামুদের দরবারি ঐতিহাসিক উতবি তাঁর ‘তারিখ-ই-ইয়ামিনি’ গ্রন্থে বলেছেন যে, “ভারত অভিযানের দ্বারা মামুদ নিজ বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি মহৎ কর্তব্য পালন করেছেন।” অর্থাৎ মামুদের ভারত অভিযান ছিল বিধর্মীদের বিনাশ করার প্রয়াস। 2. মামুদের অভিযানের বিবরণ: এইচ. ইলিয়ট তাঁর ‘History of India, as told by its own Historians’ গ্রন্থে মামুদের ভারত আক্রমণের বিবরণ রয়েছে। a. প্রথম অভিযান: মামুদ 1000 খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার ভারত আক্রমণ করে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে কয়েকটি দুর্গ দখল করেন। b. দ্বিতীয় অভিযান: 1001 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় অভিযানে মামুদ শাহীরাজ্য আক্রমণ করে জয়পালকে পরাজিত ও বন্দী করেন। এরপর শাহীরাজ্যের দায়িত্ব পুত্র আনন্দপালের হাতে দিয়ে জয়পাল আত্মঘাতী হন। c. তৃতীয় অভিযান: 1004-05 খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় অভিযানে তিনি ভীরা রাজ্যটি দখল করেন। d. চতুর্থ অভিযান: 1005-06 খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ অভিযানে তিনি মুলতানের শাসক আবুল ফতেহ দাউদ এবং শাহী রাজ্যের আনন্দপালকে পরাস্ত করেন। e. পঞ্চম ও ষষ্ঠ অভিযান: [1] 1008 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চম অভিযানে তিনি আনন্দপালের পুত্র সুখপালকে (নওশা শাহ) পরাজিত করে সমগ্র মুলতানকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। ফলে রাজ্যচ্যুত আনন্দপাল উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লি ও আজমিরের শাসকদের নিয়ে সম্মিলিত বাহিনী গঠন করে মামুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। [2] কিন্তু ষষ্ঠ অভিযানে মামুদ এই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। f. সপ্তম অভিযান: 1009 খ্রিস্টাব্দে সপ্তম অভিযানে মামুদ পুনরায় আনন্দপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্যের রাজধানী নন্দনহ দখল করেন। ফলে আনন্দপাল মামুদের বশ্যতা স্বীকার করেন। g. অষ্টম অভিযান: 1010 খ্রিস্টাব্দে অষ্টম অভিযানে তিনি মুলতানের বিদ্রোহী শাসক আবুল ফতে দাউদকে পরাজিত করেন। h. নবম অভিযান: 1011 খ্রিস্টাব্দে নবম অভিযানে মামুদ থানেশ্বর আক্রমণ করে প্রচুর ধনরাশি লুণ্ঠন করেন এবং চক্রস্বামীর মূর্তি গজনীতে নিয়ে যান। i. দশম ও একাদশ অভিযান: 1012-13 খ্রিস্টাব্দে দশম ও একাদশ অভিযানে তিনি কাশ্মীরের ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করে শাহী রাজ্য দখল করেন। j. দ্বাদশ অভিযান: 1018 খ্রিস্টাব্দে দ্বাদশ অভিযানে মামুদ কনৌজ ও মথুরা লুণ্ঠন করেন এবং সাতটি দুর্গ দখল করেন। পরাজয়ের গ্লানিতে মথুরার রাজা কুলচাঁদ আত্মঘাতী হন। k. ত্রয়োদশ অভিযান: 1020-21 খ্রিস্টাব্দে ত্রয়োদশ অভিযানে তিনি চান্দেল্ল বংশীয় রাজা বিদ্যাধরের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলে ত্রিলোচনপাল তাঁকে বাধা দেন। মামুদ ত্রিলোচনপালকে পরাস্ত করেন। l. চতুর্দশ অভিযান: 1021 খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশ অভিযানে তিনি ত্রিলোচনপালের পুত্র ভীমপালকে পরাজিত করে শাহী বংশের অবসান ঘটান এবং পাঞ্জাব রাজ্য গজনী সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। m. পঞ্চদশ অভিযান: 1021-22 খ্রিস্টাব্দে পঞ্চদশ অভিযানে তিনি গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর ও চান্দেল্ল শাসকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। যুদ্ধে চান্দেল্ল রাজা বিদ্যাধর মামুদের কাছে পরাজিত হন। n. ষোড়শ অভিযান: 1024 খ্রিস্টাব্দে ষোড়শ অভিযানে মামুদ গুজরাটের চালুক্য রাজা ভীমকে পরাস্ত করেন। এরপর সোমনাথ মন্দির লুণ্ঠন করেন এবং প্রভূত ধনসম্পদ গজনীতে নিয়ে যান। এই অভিযানে তিনি অসংখ্য নরনারীকে হত্যা করেন। o. সপ্তদশ অভিযান: ভারতে মামুদের সর্বশেষ অভিযান ছিল 1027 খ্রিস্টাব্দে সিন্ধুর জাঠদের বিরুদ্ধে অভিযান। 3. উপসংহার: শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক দিক থেকেই নয়, রাজনৈতিক দিক থেকে মামুদের ভারত অভিযান তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই অভিযান ভারতীয় রাজাদের সামরিক দুর্বলতাকে প্রকট করে। এর ফলে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীকালে বৈদেশিক আক্রমণের পথকে প্রশস্ত করে তোলে। সুলতান মামুদের ভারত অভিযান সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “সুলতান মামুদ ছিলেন এক ক্ষমতাশালী লুণ্ঠনকারী দস্যু।”

তুর্কি আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন? Causes of failure of Indian states to resist Turkish invasion.

 

তুর্কি আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থ হয়েছিল কেন?

- সুভাষ বিশ্বাস,

ইতিহাস বিভাগ,

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়

=====================================================================

Causes of failure of Indian states to resist Turkish invasion.



ভূমিকা: খ্রিস্ট্রীয় অষ্টম শতক থেকে উত্তর ভারত বৈদেশিক আক্রমণকারীদের কাছে স্বর্গরাজ্য হয়ে ওঠে। তখনও পর্যন্ত আক্রমণকারীরা ভারতের অভ্যন্তরে ঢোকার চেষ্টা করেনি। এই পথ ধরে পরবর্তীকালে দশম শতকের শেষ ও একাদশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতে প্রথম তুর্কি আক্রমণ শুরু হয়। তুর্কি আক্রমণের প্রাক্কালে উত্তর ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তির অস্তিত্ব ছিল না। তখন বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্বল স্থানীয় শাসকদের কাছে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আঞ্চলিকতার ভাবই বড় হয়ে ওঠে। এই সুযোগে বহিরাগত তুর্কিরা ভারত আক্রমণ করে সাফল্য পায়। তুর্কিদের আক্রমণ প্রতিরোধে ভারতীয় রাজ্যগুলি ব্যর্থতার কারণগুলি নীচে আলোচনা করা হল—

1. কেন্দ্রীয় শক্তির অভাব: তৎকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় শক্তি এবং স্থানীয় শক্তিগুলির মধ্যে সর্বভারতীয় চেতনার অভাব ছিল। তারা নিজ নিজ রাজ্যের আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায়ই বেশি আগ্রহী ছিল। বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ শক্তিজোট গড়ে তোলার কোনো চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না। উপরন্তু তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে মত্ত ছিল। ফলে স্থানীয় ভারতীয় শক্তিগুলি তুর্কি আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। বেশকিছু শক্তিশালী রাজপুত রাজ্য তুর্কি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। আর তুর্কিরা জয়লাভ করে উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

2. দক্ষ নেতৃত্বের অভাব: তুর্কি সেনাবাহিনীতে মহম্মদ ঘুরি ও কুতুবউদ্দিন আইবকের মতো সুদক্ষ সামরিক নেতৃত্ব ছিল। তাদের সমগোত্রীয় নেতা ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে ছিল না। বিভিন্ন জাতির লোকেদের নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল ভারতীয় বাহিনীকে একই রণকৌশলে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এজন্য তাদের রণকৌশলে কোনো ঐক্য ও সংহতি ছিল না। একই রাজ্যের ভারতীয় বাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন রণকৌশল ও রণদক্ষতা দেখা যেত। তাছাড়া ভারতীয় বাহিনীতে কোনো আদর্শবাদ না থাকায় তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা মনোবল হারিয়ে ফেলে।

3. ত্রুটিপূর্ণ রণকৌশল: ভারতীয় রাজপুত সেনা সংগঠন ও যুদ্ধ কৌশল ছিল প্রাচীন ধাঁচের। তারা নিজেদের প্রাচীন ধারাকে জগতের সেরা রণনীতি বলে মনে করত। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার উন্নত বল্লমধারী অশ্বারোহী সেনাবাহিনীর নতুন রণকৌশল ভারতীয় সামরিক বাহিনীর উপর কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। তারা গুপ্তচরের মাধ্যমে তুর্কিদের মতো শত্রুর গতিবিধির খবর রাখত না। ভারতীয় রাজপুত সেনাদের যুদ্ধনীতি ছিল মূলত আত্মরক্ষামূলক। তারা ডানে, বামে ও মাঝে— এই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ ও ছত্রভঙ্গ করত।

4. শক্তিশালী তুর্কি সামরিক সংগঠন: সামরিক দিক থেকে ভারতীয় রাজপুত সেনাদের চেয়ে তুর্কিরা ছিল উন্নত। তারা রাজপুতদের রণকৌশল বুঝে আক্রমণাত্মক যুদ্ধকৌশল গ্রহণ করে। তাদের যুদ্ধনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল দুর্গ বা সামরিক ঘাঁটি আক্রমণ না করে শত্রুপক্ষকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাস্ত করা। তুর্কি ঘোড়-সওয়াররা জনপদগুলি এড়িয়ে ছুটন্ত অবস্থায় তীর ছুঁড়ত এবং বল্লম দ্বারা শত্রুকে আঘাত করত। এই ধরনের নিত্যনতুন রণকৌশল সম্পর্কে ভারতের রাজপুত সেনাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয় পদাতিক বাহিনী ও তরবারির ব্যবহারে অভ্যস্ত রাজপুত সেনারা এই দুর্ধর্ষ তুর্কি সেনাদের মোকাবিলা করতে পারেনি।

5. রাজপুত রাজাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব: রাজপুত রাজারা নিজ নিজ স্বার্থ-রক্ষার্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্ন ভারতীয় শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে তুর্কিদের প্রতিরোধ করার মতো সুযোগ্য নেতা রাজপুতদের মধ্যে তৈরি হয়নি। সমাজে ধনবন্টনের কোনো পদ্ধতি না থাকায় উচ্চবর্গের লোকেরা সম্পদশালী হলেও নিম্নবর্গের লোকেরা ছিল অবহেলিত ও নির্যাতিত। তারা রাজপুত নেতাদের কাছ থেকে সামাজিক ন্যায়বিচার পায়নি। এ প্রসঙ্গে আলবিরুনী মন্তব্য করেছেন যে, “হিন্দুদের কোনো ব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ত, তাকে সংস্কার করে তার পূর্ণ জীবনদানের কোনো আগ্রহ দেখা যেত না।”

6. হিন্দু সমাজের দুরবস্থা: আর. সি. দত্ত, ড. হাবিব প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ভারতীয়দের পরাজয়ের জন্য মূলত হিন্দু সমাজের রক্ষণশীল নীতিকে দায়ী করেছেন। এর জন্য মূলত জাতিভেদ প্রথাকে দায়ী করা যেতে পারে। হিন্দুদের প্রতিক্রিয়াশীল সমাজব্যবস্থায় উচ্চবর্ণের হিন্দুরা সকল সুযোগ-সুবিধা পেলেও নিম্নবর্ণের পতিত ও অস্পৃশ্য মানুষ ছিল অবহেলিত। একমাত্র ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দেরই ধর্মশাস্ত্র পাঠ ও রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের অধিকার ছিল। তাই তুর্কি আক্রমণকারীদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এই শ্রেণি নিষ্ক্রিয় থাকে।

7. কুসংস্কার ও অবক্ষয়: বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, বিধবা বিবাহ, সতীদাহ প্রভৃতির মতো কুপ্রথা তৎকালীন হিন্দু সমাজকে জর্জরিত করে। সমাজে কোনো নৈতিকতা ও আদর্শবাদ না থাকায় হিন্দুসমাজ অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কুসংস্কার ও কুপ্রথার পালন তৎকালীন সমাজের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। নানা সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যভিচার ও অবিচার হিন্দু সমাজকে পুঙ্গ করে দেয়। বিভিন্ন কুসংস্কার ও কুপ্রথায় বিভক্ত হিন্দু সমাজে জাতীয় চেতনার অভাব দেখা দেয়। প্রজাদের মধ্যে যুগোপযোগী রাষ্ট্র গঠনের নীতিগত চেতনার অভাব ছিল। ফলে তুর্কিদের মতো শক্তিশালী বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হয়।

8. সামন্তপ্রথা: তুর্কি বিজয়ের প্রাক্কালে রাজপুত রাজ্যগুলিতে সামন্তপ্রথা প্রচলিত ছিল। ফলে তৎকালীন স্থানীয় শক্তিগুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ও স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হয়। এই প্রথায় অভিজাত ও বণিকরা বিলাস-ব্যসনে দিন কাটালেও সাধারণ কৃষক-কারিগর শ্রেণী ছিল অবহেলিত। তুর্কি আক্রমণের সময় অবহেলিত ও বঞ্চিত এই শ্রেণী নীরব ভূমিকা পালন করে।

9. উপসংহার: ///


Wednesday, 31 August 2016

নদীয়া জেলার তপসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ: একটি কেস স্টাডি

নদীয়া জেলার তপসিলি সম্প্রদায়ের মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণঃ 

একটি কেস স্টাডি


মনোজ কুমার হালদার
সহকারী অধ্যাপক, রাষট্রবিজ্ঞান বিভাগ, 
নেতাজী সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

--------------------------------------------------------------------------------------------------

         


  গণতন্ত্র শব্দটির ইংরাজী প্রতিশব্দ Democracy। এই Democracy শব্দটির উৎপত্তি দুটি গ্রীক শব্দ `Demos’ এবং `Kratos’ থেকে। `Kratos’ শব্দটির অর্থ জনগণ এবং  `Kratos' শব্দটির অর্থ শাসন অর্থাৎ গণতন্ত্র শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল জনগণের শাসন এই ধারণাটি জনপ্রিয় হয়েছে আব্রাহাম লিঙ্কনের পরিভাষায়, গণতন্ত্র হল জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা জনগণের শাসনব্যবস্থা। পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকার নির্বাচিত হয় জনগণের দ্বারা, জনগণের সকল অংশের প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে। এখানে প্রশ্ন ওঠে, গণতন্ত্রে সত্যিই কি সমাজের প্রতিটি অংশের মানুষের দ্বারা সরকার নির্বাচিত হয়? বা সরকার নির্বাচনে প্রত্যেকের সুযোগ থাকে? গণতান্ত্রিক সরকার কি সত্যিই জনগণের প্রতিটি অংশের জন্য কাজ করে? এই প্রেক্ষিতে ভারতীয় সমাজে নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের প্রশ্নটি উল্লেখের দাবী করে। ‘নারী’ এক ব্যাপক বর্গনাম হিসাবে দেখলে অবশ্যই ভারতীয় সমাজে নারীরা এখনো রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সেভাবে করতে পারে নি, পুরুষদের তুলনায় নারী অনেক পিছিয়ে। আবার নারী বর্গ পরিচয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিসর যেমন, জাত, ধর্ম,বর্ণ, শ্রেণী, পেশা, গ্রাম-শহর ভেদে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার সাধারণ নারী বর্গের তুলনায় ভিন্ন ভিন্ন হয়। বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে তপসিলি জাতি, উপজাতি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, গ্রামীণ, অসংগঠিত ক্ষেত্রের নারী শ্রমিকদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার খুবই কম। সত্যিকারের গণতন্ত্রে এই বিশাল বর্গের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ভীষণ জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ।
          একথা সর্বজন বিদিত, নারীরা সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতিতে পিছিয়ে তেমনি রাজনীতির অঙ্গনে সমানভাবে পশ্চাদ্পদ। এই ঐতিহ্য প্রাচীন কাল থেকে নারী বহন করে চলেছে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। যদিও ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও সংবিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে নারীদের জন্য কিছু সাংবিধানিক ও আইনগত অধিকার, সুযোগ-সুবিধা স্বীকৃত হয়েছে। আইনের চোখে নারী- পুরুষ সমান, সমান সুযোগ সুবিধা গ্রহণের অধিকারী। কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় ক্ষেত্রেও বটে। কিন্তু বাস্তব অন্য কথা বলে- সংবিধান বা আইন করে নারীদের সমান সুযোগ-সুবিধা, অধিকার দিলেই হয় না তা গ্রহণের সক্ষমতা সবার আগে প্রয়োজন। সেই সুযোগের অভাবেই নারী তার জন্য ধার্য অধিকার, স্বাধীনতা ভোগে অপারগ, অক্ষম। এবং সমানভাবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারী একইরকম ভাবে পিছিয়ে। নারীর মধ্যে আবার তপসিলি জাতি, উপজাতি নারীরা অবহেলিত পিছিয়ে পড়া নারীদের মধ্যেই আবার সবচেয়ে পিছিয়ে। এখানেই একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন আসে, এই পিছিয়ে পড়া তপসিলি জাতির মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনা কেমন? তাদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হার কিরূপ? তারা কেমন রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা করে?
          তবে এ প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ কাকে বলে তা বলা দরকার। রাজনেতিক অংশগ্রহণকে যেখানে গণতন্ত্রে একটি মৌল শর্ত হিসাবে গণ্য করা হয়। লুসিয়ান পাই সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়াকে পরিব্যপ্ত করাকেই রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলেছেন। হারবার্ট ম্যাক্ক্লস্কি-র মতানুসারে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলতে সমাজের সদস্যদের বিশেষ কিছু স্বেচ্ছামূলক কাজকর্মকে বোঝায়। এই সমস্ত কাজকর্মের মাধ্যমে শাসকদের বাছাই করা এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারী নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে তারা অংশগ্রহণ করে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক বিভিন্ন কাজকর্মের কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে ভোটদান, রাজনৈতিক দলের সমর্থনে আর্থিক সাহায্যপ্রদান, ধর্মঘট ও ধর্ণায় অংশগ্রহণ, মিটিং-মিছিলে যোগদান, আইনসভার সদস্য ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সঙ্গে সংযোগ সাধন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, আবার অধিকতর সক্রিয় প্রকৃতিরও হয় যেমন দলের সদস্যপদ গ্রহণ, দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে নির্বাচনী প্রচার কাজে অংশগ্রহণ, নির্বাচনী মিটিং মিছিলে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ, সরকারী ও দলীয় পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হওয়া প্রভৃতি। আবার এই সমস্ত কাজকর্মের বিপরীত ধারাকে বলা যায় উদাসীনতা বা নির্লিপ্ততা। অ্যালমন্ড ও পাওয়েলÑ এর মতে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সমাজের সদস্যদের সংযুক্ত থাকার বিষয়টিই হল রাজনৈতিক অংশগ্রহণ। তবে অনেক রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানী বাস্তব রাজনৈতিক আচরণ ছাড়াও রাজনৈতিক অংশগ্রহণমূলক পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্ক বা মনোভাবকেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার পাশাপাশি পরোক্ষ যোগাযোগকেও রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বলা যায়।
          আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রাজনীতি শুধু পুরুষদের এক্তিয়ার, মহিলারা সেখানে এখনো ব্রাত্য। পরিসংখ্যান সেকথাই বলে। আমাদের জাতীয় আইনসভার জনপ্রতিনিধি কক্ষ লোকসভায় আজ পর্যন্ত ১৩% নীচে মহিলা প্রতিনিধি নির্বাচিত থেকে গেছে। রাজ্য আইন সভাগুলিতেও নারীর অংশগ্রহণ প্রায় অনুরূপ। আসলে ভারতীয় নারী শুধু রাজনীতিতে নয় সমাজের সকল ক্ষেত্রেই, কি অর্থনৈতিক, কি সাংস্কৃতিক বা শিক্ষায় পিছিয়ে আছে। তার প্রতিফলন অবশ্যই রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য। ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলেও নারী তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তার সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় নারীকে সেভাবে গড়ে তোলেনি। রাজনীতি বাইরের বিষয়, বড় বিষয়, নারীতো অন্তপুরবাসিনী, সংকীর্ণ গণ্ডিতে সে সীমাবদ্ধ। গণতান্ত্রিক শাসন, আইনের অধীন সেও, কিন্তু আইন রচনায় তার কোন ভূমিকা নেই। এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রেও এক রূপ।
          তবে আশার কথা ভারতীয় সংবিধানে যে মৌল নীতি ঘোষিত হয়েছে তার মূলকথা- সাম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্যরোধ, সমাজের সকল ক্ষেত্রে। সংবিধান তথা আইনগত সাম্য ও অধিকার আজ স্বীকৃত। বর্তমানে নারীর রাজনৈতিক অধিকার তথা অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে সরকারীস্তরে  সক্রিয় পদক্ষেপ লক্ষ্যণীয়। ১৯৯৩ সালে সংবিধানের ৭৩ ও ৭৪ তম সংশোধনীর মাধ্যমে যেখানে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদেও এক তৃতীয়াংশ অংশ আসন সংরক্ষিত করা হয়েছিল আজ তা ক্রমবর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইনে মহিলাদের জন্য ৫০% আসনও সংরক্ষিত হয়েছে যাতে আনুপাতিক হারে তপসিলি জাতি উপজাতির মহিলাদের আসনও সংরক্ষিত। তবে গ্রামীণ স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদের নির্বাচন সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৭৩ তম সংবিধান সংশোধন আইনের প্রয়োগ দু’দশক অতিক্রান্ত। এখন সময় এই দু’দশকে নারী কতটা রাজনৈতিক সচেতন হল? তাদেরও অংশগ্রহণের প্রকৃতিই বা কেমন? এই প্রেক্ষিতেই নদীয়া জেলার তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলাদের মধ্যে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের প্রকৃতি অনুধাবনের লক্ষ্যে নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার ক্ষেত্রসমীক্ষায় যে বিষয়গুলি উঠে  এসেছে সেগুলি হল নিম্নরূপ।
          নদীয়া জেলার জনবিন্যাসে তপসিলি জাতিভুক্ত মানুষের  সংখ্যা জেলার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ; সুতরাং এই সম্প্রদায়ের মানুষের মতামত নদীয়া জেলা তথা রাজ্যের রাজনীতিকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করবে একথা বলাই যায়। এই ৩০ শতাংশ মানুষের মোটামুটি অর্ধেক নারী, তাদের মতামত, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্রসমীক্ষার এলাকা নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমা, যার অধীনে চারটি ব্লক যথাক্রমে করিমপুর-১, করিমপুরÑ২, তেহট্টÑ১ ও তেহট্টÑ২্ এই চারটি ব্লক থেকে দুটি করে পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে মোট ৬ টি পঞ্চায়েত এলাকা থেকে ১০ জন করে তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলা ভোটার বেছে নেওয়া হয় র‌্যান্ডাম স্যাম্পলিং নীতির ভিত্তিতে। তাদের সাথে সাক্ষাৎকার ও কিছু তালিকাবদ্ধ প্রশ্নের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। সেই সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে যে বিষয়গুলি উঠে আসে সেগুলি হল নিম্নরূপ:
          সমীক্ষায় স্যাম্পেল হিসাবে যাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাদের মধ্যে ৫৯% হল ১৮- ৩০ বছর বয়েসী, ৩৩% হল ৩১-৫০ বছর বয়সী এবং মাত্র ০৮% ৫০ বছরের উর্দ্ধে। ৮১% বিবাহিত, ১২% বিধবা এবং মাত্র ০৬% অবিবাহিতা। ৬২% পরিবারের মাসিক আয় ৪Ñ৫ হাজার টাকার মধ্যে।
          তাদের ৬৭% অষ্টম মান বা তার নীচুমান পর্যন্ত শিক্ষাগ্রহণ করেছে। ২৩% মাধ্যমিক, ১৬% উচ্চমাধ্যমিক পাশ এবং ২৪% অক্ষর জ্ঞান বর্জিত। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৭২% গৃহবধূ,  যাদের কোন অর্থকরী পেশা নেই, ২% সরকারী চাকুরীরতা, ৩% ছোট ব্যবসায় যুক্ত এবং ২৩ শতাংশ ক্ষুদ্র কুটীর ও হস্ত শিল্পে নিযুক্ত।
          সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা চোখে পড়ার মত সেটি হল, খুব সামান্য অংশই রাজ্য, জাতীয় বা স্থানীয় প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি সম্পর্কে অবহিত উত্তরদাতাদের খুব ক্ষুদ্র অংশ সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত। ৮৬% উত্তরদাতা রাাজনেতিক বিষয়ে পরিবার প্রধানের উপর নির্ভরশীল বলে জানান।
          সমীক্ষার সময়ে প্রশ্ন্-উত্তর ও উত্তরদাতাদের সাথে কথা বলে যে বিষয়গুলি উঠে আসে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল তারা প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই বিবাহিত এবং সেকারণে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ হয়নি, ফলত: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরোপুরি পুরুষ পরিবার প্রধানের অধীন। এবং পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল সে কারণে পরিবারের মহিলারা কিছু হস্তশিল্প ও কুটীর শিল্পের সাথে এবং কৃষি শ্রমিকের  কাজে যুক্ত। তাদের অধিকাংশকেই পরিবারের শিশু ও বয়স্ক সদস্যদের দেখভাল, প্রাত্যহিক গৃহকর্ম ও গৃহপালিত পশুপাখিদের পরিচর্যা করতে হয় এসবের পর তাদের আর বাইরের জগৎ ‘রাজনীতি’ বিষয়ে আগ্রহ থাকে না বলে জানান।
          একথা ঠিক, সমগ্র দেশ, রাজ্য বা জেলার সাথে এই মহকুমার ঘটনা কোন ব্যাতিক্রম নয়। তপসিলি সম্প্রদায়ের মানুষ অর্থনৈতিক অবস্থায় ও সামাজিক অবস্থানে পিছিয়ে তার প্রতিফলন রাজনৈতিক অংশগ্রহণে প্রতিফলিত হয়। তবে আশার কথা নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার হার ক্রমবর্ধমান, ফল হিসাবে তারা সচেতনতায় আধুনিক চিন্তাধারায় প্রবীণদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। বর্তমান প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে প্রবীণদের তুলনায় আগ্রহী ও সচেতন। বিগত দুই দশকে গ্রামীণ স্বায়ত্ব শাসন প্রতিষ্ঠানগুলিতে মহিলাদের আসন সংরক্ষণের সুবাদে তপসিলি জাতিভুক্ত মহিলারা তুলনামূলক বিচারে বর্তমানে অনেকাংশে রাজনীতি সচেতন হয়েছেন।   

Saturday, 4 June 2016

রবীন্দ্র চেতনায় অখন্ড ভারত - ড. সঞ্জয় প্রামাণিক






রবীন্দ্র চেতনায় অখন্ড ভারত
. সঞ্জয় প্রামাণিক
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর,
বাংলা বিভাগ,
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ।


বিশ্বের মানব সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরেছেন সৃষ্টি-কর্মের মাধ্যমে। সাহিত্য সাধনার পাশাপাশি একজন দেশপ্রেমিক হিসাবেও তিনি আমাদের কাছে পরিচিত
তাঁর চেতনায় দেশপ্রেম মানে খণ্ডিত ভারত নয়, অখণ্ডিত ঐক্যবদ্ধ ভারত। তিনি  কেবল ভারতের কবি নন, সমগ্র বিশ্বের। তাঁর কর্ম, ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁর সাহিত্য কর্মের মধ্যে যেমন ছিল সৃষ্টিশীল প্রতিভার চুড়ান্ত নিদর্শন, তেমনি জীবন-কর্মের মধ্যেও ছিল সম্ভবনার চুড়ান্ত ইঙ্গিতরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় ভারতবর্ষ ছিল পরাধীন এবং অখণ্ড। কিন্তু এমন এক সময় এল যখন ভারতবর্ষ খণ্ডিত হওয়ার মুখে, দেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন; করেছিলেন রাখী বন্ধন উৎসব, রচনা করেছিলেন স্বদেশ প্রেমমূলক গান, ভ্রাতৃত্বের আহ্বান জানিয়েছিলেন সকল সম্প্রদায়কেএর মধ্যে কবির স্বদেশ ভাবনার পূর্ণ প্রতিফলন পাওয়া যায়, পাওয়া যায় স্বদেশ প্রেমের কথাও  



      রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বাধীন ভারতের স্বাদ পেয়ে যান নি। ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার ছ’বছর পূর্বেই তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন। নানা বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হল বটে, তবে তা এল বিশাল ভারত ভূখণ্ডকে খণ্ডিত করেতিনি এই খণ্ডিত ভারতভূমির স্বাধীনতা চাননি। চেয়েছিলেন অখণ্ড স্বাধীন ভারত। ভারতভূমিকে খণ্ডিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য তিনি ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ‘রাখি’ বন্ধন উৎসবের মাধ্যমে সমগ্র ভারতকে এক সূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। এই ‘রাখি’ বন্ধন উৎসব মিলন, প্রেম, ঐক্য, ভ্রাতৃত্বের প্রতীক। ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর (৩০-এ আশ্বিন) সকাল বেলায় কবি নিজে এবং ক্ষেত্রমোহন ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাড়ির ভৃত্যরা এছাড়াও পাড়ার ছেলে-মেয়ে-বউ সকলেই পায়ে হেঁটে শোভাযাত্রা সহকারে – 
‘বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল-
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক
হে ভগবান

         এই স্বদেশ প্রেম মূলক গান গাইতে গাইতে গঙ্গার ঘাটে স্নান করে একে অপরের হাতে রাখি পরিয়ে মিলনোৎসব পালন করলেনএবং ফেরার পথে এক আস্তাবলে প্রবেশ করে মুসলিম ভাইদের হাতে রাখি পরিয়ে দিয়ে ভ্রাতৃত্বের, প্রেমের বন্ধনে মিলিত হলেন। এই মিলনোৎসব চিতপুরের বড়ো মসজিদের মৌলবিরা হাসি মুখে মেনে নিয়ে অভ্যর্থনা জানালেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বাদেশিকতার ও অখণ্ড ভারত প্রেমের বড় পরিচয় পাওয়া যায়।        
           
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশ ভাবনা কেবল বাংলাকে ঘিরে নয়; সমগ্র অখণ্ড ভারতকে ঘিরে। অখণ্ড ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু-মুসলমান তথা বিভিন্ন জাতির মধ্যে মিলনের কথা ভেবেছিলেন কারণ মিলনই মানুষে মানুষে ঐক সাধন করেতাই তিনি বলেছিলেন,- ‘হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন-
শক-হুন-দল পাঠান মোঘল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার,
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’  

      অর্থাৎ তিনি ভারতবর্ষকে সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র রূপে দেখেছিলেন কবির আশা ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয় দেশের সভ্যতা আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাগরতীরের এই উপমহাদেশ মহাতীর্থে পরিণত হবে। কিন্তু দেশ জুড়ে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধকে প্রত্যক্ষ করে তিনি মর্মাহত এবং ব্যথিত হয়ে বলেছিলেন,- ‘...হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম-দ্বারাই পরস্পরকেও জগতের অন্যান্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলিয়া রাখে ধর্ম মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করেতাই কবি ধর্মের পরিবর্তে মানবধর্মের কথা বলেছেন; যে মানবধর্ম মানবতা জাগাতে পারে; মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে পারে। ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের অভাবের কথা বলেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন,- স্বদেশিযুগে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল আরোপিত বা অভিনয়ের মত। মুসলমান, হিন্দু ভাইদের আহ্বানে উদ্বেলিত হয়নি। কারণ উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ বেআব্রু হয়ে পড়েছিল। তাই হিন্দু স্বদেশী প্রচারক জল পানের সময় মুসলমান প্রতিবেশীকে দাওয়া থেকে নেমে যেতে বলে। কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বত্র এই বেআব্রু ভাব ছিল। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্মতা গড়ে ওঠেনি। এতে বঙ্গভঙ্গ আরও সহজতর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুঝেছিলেন বঙ্গভঙ্গ রোধ করা যাবে না, যদি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করা না যায়। সেই কারণেই তিনি ‘রাখি’ বন্ধন উৎসবের মধ্য দিয়ে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে প্রীতিমূলক ও আন্তরিক করতে চেয়েছিলেন। কারণ রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় ছিল অখণ্ড ভারত প্রেম। কেবল হিন্দু-মুসলমান নয়, সকল সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র হয়ে অখণ্ড ভারতবর্ষ হয়ে উঠুক এক পুণ্যভূমি। ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্য গ্রন্থের ১০৬ সংখ্যক কবিতায় তিনি সে কথা বলেছেন,- 
“এসো হে আর্য, এসো অনার্য   
হিন্দু মুসলমান।
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ,
এসো এসো খৃস্টান।
এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধরো হাত সবাকার,
এসো হে পতিত করো অপনীত
সব অপমানভার

     এখানে কবির স্বদেশ প্রেম কেবল দেশবাসীকে নিয়ে নয়; আগত, অনাগত সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে অখণ্ড মানব প্রেম। এই প্রেমই উত্তীর্ণ হয়েছে বিশ্বপ্রেমে।    
                      
 ঋষিকল্প মনীষা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অখণ্ড ভারতবর্ষের রূপ-সৌন্দর্য কল্পনার সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেই সাধনার মন্ত্র দিয়েই বিশ্বমায়ের স্নেহের আঁচলের সন্ধান পেয়েছেনএখানে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ব্যক্তি মায়ের তুলনায় দেশমাতৃকাকে তিনি কম সম্মান করেননিসেই সম্মান রক্ষার জন্য গাইলেন- 
“ও আমার দেশের মাটি,
তোমার পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর
তোমাতে বিশ্বমায়ের
আঁচল পাতা!”  

       লক্ষ্যণীয় এই গীত-মন্ত্রের মধ্যে আছে কবির সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা বাংলার মাটির কথা; আছে বিশ্বপ্রেমের প্রসঙ্গও। এখানে কবি মননের অখণ্ড ভারতপ্রেম প্রসারিত হয়েছে বিশ্বপ্রেমে। এই প্রসারিত বিশ্বপ্রেমের উৎস বাংলাকে ঘিরেইবাংলার হৃদয় ভারতের সঙ্গে মিশে গেছেএই কথা ভেবে কবি গেয়ে ঊঠলেন,-
“আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে
কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির
হলে জননী!”

      এ সঙ্গীতে কেবল স্বদেশ প্রেমই নেয়; ভারতবর্ষের মর্মবস্তুর হৃদস্পন্দনের ধ্বনিও অনুভূত হয়েছেকবি এই ভাবেই স্বাদেশিকতার অনুশীলন করে নিজেকে প্রকৃত স্বদেশপ্রেমিক রপে প্রতিষ্ঠা করে স্বদেশকে পুণ্যভূমি বলেছেন তাই কবির ঋষিকণ্ঠে আবার পুণ্যবাণী উচ্চারিত হয়েছে,- 
‘হে মোর চিত্ত, পুণ্যতীর্থ জাগোরে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে...’ 

      অর্থাৎ ভারতবর্ষকে পুণ্যতীর্থ ভাবা স্বদেশ ভাবনারই ফল। আসলে কবি স্বদেশ ভাবনার ধারনাকে সংস্কার করেছেন। তাঁর স্বদেশ ভাবনা ভৌগোলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা কিম্বা ভাষভিত্তিক ঘেরাটোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা। তা ছিল নিঃস্বার্থ-মানবতাবাদের প্রকাশ। আসলে কবি অন্ধ স্বদেশ প্রেমিক ছিলেন না বা সংকীর্ণতাও তাঁর মধ্যে ছিলনা; ছিল উদার এবং মানবতা জাগরণের উপলব্ধি। সেই উপলব্ধিতেই গোরা সত্য সন্ধানী হয়েছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশী আন্দোলনের নেতা সন্দীপের মধ্যে আদর্শ ও নিষ্ঠা ততটা ছিলনা, তবে ছিল সূক্ষ্ম বিচার বোধ। আর গোরার স্বদেশ প্রেম ছিল স্নিগ্ধ ও শুচিশুভ্র সুন্দরআচার নিষ্ঠা হলেও তার মধ্যে ছিলনা কোন ফাঁকি সেই কারণেই গোরা মিথ্যাকে ছেড়ে সত্যকে লাভ করতে চেয়েছে। এবং আনন্দময়ীকে বলেছে,- ‘মা, তুমিই আমার মা। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই-শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা। তুমিই আমার ভারতবর্ষ’ ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘গোরা’ উপন্যাস দুটির মধ্যে স্বদেশ চেতনার যে রূপ পাওয়া যায় তা রবীন্দ্রনাথের বস্তুগত দৃষ্টির পরিচয় দেয়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে কেবল দেশ প্রেমিকই নন। তিনি একজন ভারত দ্রষ্ট্রাও বটে। এই ভারত দ্রষ্টার আরও দৃষ্টান্ত আছে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে ‘অনুশীলন সমিতি’র মাঠে গাওয়া গানে,- ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ এ গান কবির একার নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের। অর্থাৎ সমগ্র দেশ বাসীর মনে প্রবেশ করাতে চেয়েছিলেন ‘ভারত মাতা’ কোন বিশেষ জাতির নয়, সকল ভারতবাসীর। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বদেশিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।  এই স্বদেশ প্রেমিক যখন বলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে’ তখন তার মধ্যে একজন ভারত দ্রষ্টাকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ দেশ প্রেমিককে সর্বোপরি একজন স্বাদেশিককে সকল রকম বাঁধা মুক্ত হতে হবে। সঙ্গ না পেলে একলা চলতে হবে।                
 
        রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যক্তি জীবনে যেমন স্বাদেশিক ছিলেন। তেমনি সাহিত্য, সঙ্গীতেও স্বাদেশিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দেশবাসীকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তাই তিনি আমাদের কাছে চিরকাল যেমন সাহিত্যিক, তেমনি দেশ-প্রেমিক মহান মানব ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসেও দেশের জন্য সংগ্রামের কথা পাই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সংগ্রাম বিশ্বপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ-প্রেম বিশ্বপ্রেমে উত্তীর্ণ হয়ে মানব কল্যানের কথা বলেছেএখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্ন্তজাতিকতার স্তরে উন্নীত হয়েছেন। তাই এখানে আর সাধারণ ধর্ম চিন্তার কথা নেই, আছে মানব ধর্মের কথা, মহামানবত্বের কথা।

**********


সহায়ক গ্রন্থ :

১) পশ্চিমবঙ্গ (রবীন্দ্র সংখ্যা); তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ; ৩১ বর্ষ, ৪১-৪৬ সংখ্যা।

২) রবীন্দ্র–প্রতিভার পরিচয়; ড. ক্ষুদিরাম দাস; মল্লিক ব্রাদার্স; সেপ্টেম্বর ২০০২।

৩) রবীন্দ্র–রচনাবলী, সুলভ সংস্করণ (১ম, ৩য়, ৬ষ্ঠ, ১২শ খণ্ড); বিশ্বভারতী। 






Friday, 3 June 2016

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঃ প্রসঙ্গ স্বদেশি আন্দোলন - স্বাতী মৈত্র

রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সক্রিয়তা : প্রসঙ্গ স্বদেশি আন্দোলন


- স্বাতী মৈত্র,
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, 
বিদ্যাসাগর সান্ধ্য কলেজ, কলকাতা।
==============================================





বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের চিন্তার বিস্তার ছিল সর্বব্যাপী। সাহিত্য, শিল্পকলা, ধর্ম, শিক্ষা, সমাজ সংস্কার, রাজনীতি, দর্শন- কিছুই তাঁর চিন্তার বিষয় থেকে বাদ যায়নি। তিনি একাধারে কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার, শিল্পী ও শিক্ষাবিদ। তিনি এক হাজারের মতো কবিতা ও দুই হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন এবং অন্ততঃ তিন হাজার ছবিও এঁকেছেন। এগুলির অধিকাংশই তাঁর জীবনের শেষ দশ বছরের সৃষ্টি।  রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার কৃষ্ণা দত্ত ও অ্যাণ্ড্রু রোবিনসন উল্লেখ করেছেন যে, যুব (Rabindranath) was not an analytical thinker, always an intuitive one who preferred a poetic analogy to a prosaic argument."  সেজন্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহণের ঘটনা তাঁর একটি চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করা যায়। 
রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচিতি হল তিনি একজন কবি। একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতির উর্দ্ধে তাঁর মনকে স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। রাজনীতির ক্ষতিকারণ দিকটি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তাই প্রথম দিকে রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তিনি মনে করতেন যে, রাজনীতি সকল দেশেই নৈতিকতার অবনমন ঘটিয়েছে এবং রাজনীতির ফলেই মিথ্যা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতা ও কপটতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি-ভাবনা পরবর্তীকালে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কেননা, একজন কবি হিসাবে তিনি রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহী হলেও তিনি যেমন ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা  করেছেন তেমনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমর্থনেও এগিয়ে এসেছেন।  ১৯০৫ সালে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ভারতের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক সমস্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে আসে। তবে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভের পর রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি সমগ্র বিশ্ববাসীর নজর আকৃষ্ট হয়। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-এ সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের দেওয়া ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। এই রাজনৈতিক সক্রিয়তার দ্বারা ইউরোপের সর্বাধিক নজর আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। তাছাড়া ইতিমধ্যে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে রচিত ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ইউরোপের মনোযোগ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের অংশগ্রহণের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের স্বেচ্ছাচারী নীতির অন্যতম প্রধান রূপকার ভাইসরয় লর্ড কার্জনের উদ্যোগে ১৯০৫ সালে বাংলা দ্বিখন্ডিত হয়। এই বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলন সংগঠিত হয়। আপাতভাবে কার্জন বৃহৎ বঙ্গ বিভাজনের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদর্শন করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে এই বঙ্গবিভাগের নেপথ্যে ছিল বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে কার্জনের কুচক্রী উদ্দেশ্য। বাঙ্গালী জাতি ছিল ভারতে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ককে দ্বিখণ্ডিত ও দুর্বল করে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়াই ছিল কার্জনের মূল উদ্দেশ্য। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালী জাতি ইংরেজদের এই চক্রান্তকে সমূলে উৎখাৎ করার জন্য স্বদেশি আন্দোলনে সামিল হয়েছিল। 
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলন কতটা সফল বা ব্যর্থ হয়েছিল তা এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। এই আলোচনার মূল বিষয় হল“রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এক আদর্শায়িত গণপ্রতিরোধের চিত্র যা বাংলার নরনারীকে, জাতিকে আনার চেষ্টা করেছিল বাংলা-হৃদয় মঞ্চে।”  স্বদেশি আন্দোলনের শেষ পর্বে (১৯১০ সালে) রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে গোরা একবার ত্রিবেণীসঙ্গমে অগণিত ভারতীয়র সঙ্গে একঘাটে স্নান করে সমগ্র ভারতকে নিজের অন্তরে অনুভব করতে চেয়েছিল। সেখানে গোরার চিন্তায় কাজ করেছিল জাতীয়তাবোধ। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙ্গালীর হৃদয়ে সেই জাতীয়তাবোধেরই বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথ গোরার মতো খ-িত ভারতবর্ষের চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন না। তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সমগ্র জাতির আন্দোলনকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রাখি বন্ধন উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে একতা নির্মাণের পথে।
লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৬ সালে স্বদেশি আন্দোলন পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয়ে যায়। আক্ষরিক অর্থে ‘স্বদেশি’ বলতে বোঝায় ‘নিজের দেশের’। বিলাতী দ্রব্য বর্জন বা বয়কট করে দেশিয় দ্রব্যসামগ্রি ক্রয় করাই ছিল এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল কথা। আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল- এদেশে বিলাতী দ্রব্য বর্জন করলে ব্রিটিশরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে সঙ্কটে পরবে তেমনি দেশিয় দ্রব্য বিক্রি বৃদ্ধি পেলে দেশিয় শিল্প ও অর্থনীতির বিকাশ ঘটবে। 
তবে বলপ্রয়োগ করে বিলাতী দ্রব্যসামগ্রী বয়কট বা বর্জন করার প্রয়াস শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ তা সমর্থন করেননি। “কারণ, তিনি বুঝেছিলেন এই প্রয়াস ছিল রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত। এতে বাস্তবসম্মত বোধের অভাব ছিল।”  তিনি মনে করতেন যে, শুধুমাত্র বয়কটের দ্বারা বঙ্গীয় সমাজের মূল সমস্যাটিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হচ্ছে। আন্দোলনে তাঁর লক্ষ্য ছিল যে, মূল স্বদেশির আদর্শ জাতীয় সুপ্ত চেতনার দরজায় আঘাত হানবে আর সেই জাগ্রত চেতনার ফলে তাঁতি শুধু কাজ পাবে না- অনাথ শুধু ত্রাণ পাবে না- তা ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের, জমিদার ও কৃষকের, হিন্দু ও মুসলমানের, ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও বিভেদের অবসান ঘটাবে। কংগ্রেস দলের নেতারা যখন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করলেও জার্মান, অষ্ট্রিয়া বা আমেরিকার পণ্য ব্যবহারে কুণ্ঠাবোধ করেননি তখন স্বদেশিকতার নামে নেতাদের বিভ্রান্তিমূলক নীতির সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘কালান্তর’ পত্রিকায় লিখলেন- 
“বস্তুত যখন সমগ্রভাবে দেশের বুদ্ধিশক্তি, কর্মশক্তি উদ্যত থাকে তখন অন্যদেশ থেকে কাপড় কিনে পড়লেও স্বরাজের মূলে আঘাত লাগে না। গাছের গোড়ায় বিদেশি সার দিলে গাছ বিদেশি হয় না।”  বা “খদ্দর পরা দেশই যে সমগ্র দেশের সম্পূর্ণ আদর্শ একথা আমি কোন মতেই মানতে পারি নে।”
একদা রাজনীতি সম্পর্কে অনাগ্রহ সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা ক্রমশ ভিন্নপথে প্রবাহিত হতে থাকে। তিনি বলেন যে, রাজনীতি তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ হলেও তিনি যে দেশে, যে পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণ করেছেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক আবর্তে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে তিনি সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারেননি। তাই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে যখন স্বদেশি আন্দোলন শুরু হল তখন রবীন্দ্রনাথ শীঘ্রই তাতে জড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা প্রচারিত হলে রবীন্দ্রনাথ ১৯০৪ সালে (২২ জুলাই) ‘স্বদেশি সমাজ’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি বঙ্গভঙ্গের মূল সমস্যার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন এবং কীভাবে এর প্রতিকার সম্ভব তার-ও ব্যাখ্যা দেন। তিনি গণ স্বাক্ষর সম্বলিত তীব্র কটাক্ষপূর্ণ 'Memorial' ইংরেজ রাজদরবারে পাঠান। ১৯০৫ সালে কার্জন দুই বাংলা বিভক্ত করলে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন প্রসঙ্গে স্বদেশি গান লিখতে, বক্তব্য রাখতে এবং গণ মিছিলে অংশ নিতে শুরু করলেন। স্বদেশি আন্দোলনের অংশ হিসাবে তিনি একটি দেশলাই কারখানা, একটি ব্যাঙ্ক এবং একটি তাঁতশিল্প কেন্দ্র স্থাপন করেন। আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি ১২টি স্বদেশি সঙ্গীত রচনা করেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে, জয় মা বলে ভাসা তরী’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’, ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ ইত্যাদি। এভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্নভাবে নেতৃত্বদান করেন রবীন্দ্রনাথ। আসলে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহ থাকলেও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হওয়া স্বদেশি আন্দোলন ছিল এমনই একটি রাজনৈতিক বিষয় যার সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রবীন্দ্রনাথের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি একপ্রকার অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। 
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর যেদিন কার্জন আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে দ্বিখ-িত করেন, সেদিন এর প্রতীকী প্রতিবাদ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ ‘রাখিবন্ধন’ উৎসবের সূচনা করেন। সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের অস্ত্র চালনার দ্বারা দুই বাংলা বিভাজিত হলেও রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় বাঙ্গালী ভাইবোনেরা একে অপরের হাতে রাখি বেধে মনের অখ-তা প্রকাশ করে। তাঁর প্রেরণায় হাজার হাজার মানুষ গঙ্গার ধারে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেশাত্মবোধক গান গাইতে গাইতে মিছিল করে শহর পরিক্রমা করে। হিন্দু ও মুসলিম ভাইবোনেরা সৌভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসাবে একে অপরের হাতে রাখি বেধে দেয়। দুই বাংলার মানুষের মনোজগতের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে রাখিবন্ধনের উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গান-
বাংলার মাটি, বাংলার জল,
বাংলার বায়ু, বাংলার ফল,
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক,
পুণ্য হউক, হে ভগবান। 
প্রথমদিকে স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা ছিল অহিংস ও অসহযোগ। কিন্তু যখন কিছু জাতীয়তাবাদী নেতা অহিংস অসহযোগের পথ পরিহার করে আন্দোলনকে চরমপন্থী ও সন্ত্রাসবাদী পথে পরিচালিত করেন তখন রবীন্দ্রনাথ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। যারা আপাতভাবে নিরীহ এবং এই আন্দোলন সম্পর্কে উদাসীন, তাদের যখন জোর করে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তিনি প্রমাদ গণেন।  রবীন্দ্রনাথের আন্দোলন এই সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধেও। তিনি মনে করেন যে, যে ব্যক্তির ধর্ম অন্যের ধর্মকে অবজ্ঞা করতে শেখায়, যার সবকিছুই প্রতিবেশির স্পর্শে অপবিত্র হয়ে যায়, অন্যের ধর্মের অবমাননা করেই যার পবিত্রতা রক্ষা করতে হয় সেই ব্যক্তি অবমাননারই যোগ্য।  রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনের এই কুৎসিত দিকগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে গঠনমূলক স্বদেশির প্রচার হোক। সমাজে শিক্ষিত ভদ্রলোক শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে সে সম্পর্কে সচেতন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি চেয়েছিলেন স্বেচ্ছাসেবকরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে গ্রামবাসীদের অভাব-অভিযোগগুলি উপলব্ধি করুক।  রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চরমপন্থী ও নরমপন্থী আদর্শের বিরোধ ও বাড়াবাড়িকে বা বাইরে থেকে আন্দোলনের মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়াকেও সমর্থন করেননি। তাছাড়া তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, আন্দোলনে ক্রমে হিন্দুত্ববাদী প্রভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল এবং মুসলিম সমাজকে আন্দোলন থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। তাই মুসলিমদের অনেকেই মনে করতেন যে, এটি আসলে হিন্দুদের আন্দোলন। তাই তারা এই আন্দোলনে আন্তরিকভাবে সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেনি।  তাছাড়া আন্দোলনের সময় এক শ্রেণির পুনরুজ্জীবনবাদীর উদ্যোগে সমাজে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিভেদ বৃদ্ধি পায়। কিছু জাতীয়তাবাদী নেতার উৎসাহে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এর পরিণতিতে ১৯০৬ সালের মে মাস থেকে ১৯০৭ সালের মে মাসের মধ্যে পূর্ববঙ্গে বেশ কয়েক স্থানে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে যায়।  
এরপর আন্দোলন ক্রমে সন্ত্রাসবাদী পথে অগ্রসর হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ খুবই হতাশ হয়ে পড়েন। ১৯০৮ সালে ক্ষুদিরাম বসু বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ দুই ইংরেজকে হত্যা করেন। অহিংস অসহযোগ থেকে আন্দোলন ক্রমে সহিংস আগ্রাসী পন্থায় পরিচালিত হতে শুরু করলে রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তিনি তাঁর বহু স্বদেশবাসীর বিভিন্ন সমালোচনার শিকার হন। সমালোচকদের কেউ কেউ আবার তাঁকে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগী বলে বিদ্রুপ করেন। তাই রবীন্দ্রনাথ স্বদেশি আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করলেন। স্বদেশি আন্দোলনে মোহভঙ্গ হওয়ার পর থেকে তিনি আর কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নিজেকে যুক্ত করেননি। 
স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বাধিক পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে। ১৯১৫ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ যে শুধু সমকালীন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ করেছেন তা-ই নয়, এটিই হল ‘সাধু ভাষা’ পরিত্যাগ করে ‘চলিত’ বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস।  ফলে তখন থেকেই সংস্কৃত-প্রেমী পণ্ডিতমহল এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ "The Home and the World" প্রকাশিত হলে ইউরোপেও এর ব্যাপক সাড়া পড়ে।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে স্বদেশি আন্দোলন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা নিখিল, বিমলা ও সন্দীপের চরিত্রের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে। নিখিলের চরিত্রে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির ছায়াই দেখতে পাওয়া যায়। উপন্যাসের নিখিল একজন সদয়, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল জমিদার। তার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা ধর্মীয় গোঁড়ামির মানসিকতা নেই, আছে দেশপ্রেম। নিখিলের বন্ধু সন্দীপ ছিল স্বার্থপর এবং স্বদেশি আন্দোলনের পন্থা হিসাবে চরমপন্থার উগ্র সমর্থক। জাতীয়তাবাদী সন্দীপের নীতিকে নিখিল সমর্থন করেনি। নিখিল ও সন্দীপের পরস্পর-বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে ফাঁপরে পড়ে যায় নিখিলের স্ত্রী বিমলা। আবেগতাড়িত জাতীয়তাবাদী রাজনীতির স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতে গিয়ে নিখিল ক্রমে সামগ্রিক পরিস্থিতি, এমনকি তার স্ত্রী বিমলার কাছ থেকেও একাকী হয়ে পড়ে। বিমলা ক্রমে সন্দীপের ক্যারিশ্মাটিক ব্যক্তিতে আকৃষ্ট হতে থাকে। স্বদেশি আন্দোলনের নামে সন্দীপ যখন গ্রামের দরিদ্র ও নিরীহ বাসিন্দাদের স্বদেশি দ্রব্যসামগ্রি কেনার জন্য বলপ্রয়োগ শুরু করে তখন নিখিল তাতে সায় দেয়নি। কেননা, স্বদেশি জিনিসপত্রের মূল্য যেমন বিলাতী দ্রব্যের চেয়ে বেশি তেমনি দ্রব্যের গুণগত মান ল্যাঙ্কাশায়ার বা ম্যানচেস্টারে উৎপাদিত দ্রব্যের চেয়ে কম। বাংলার দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে বিলাতী দ্রব্যেরই বেশি প্রয়োজন ছিল। যখন এই দরিদ্র ও নিম্নবর্ণের মানুষের উপর ‘স্বদেশির’ নাম করে জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ বলপ্রয়োগ শুরু করলেন তখন রবীন্দ্রনাথ ক্রমে আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে থাকলেন। তিনি ১৯০৮ সালে প্রকাশিক ‘সদুপায়’ নামে এক প্রবন্ধে একজন বাঙ্গালী হিসাবে আত্মসমালোচনা করে উল্লেখ করলেন যে, আমাদের দুর্ভাগ্যই হল- আমরা স্বাধীনতা চাইলেও আমরা অন্তর থেকে স্বাধীনতায় বিশ্বাস করিনা। 
নিখিল উপলব্ধি করেছিল যে, বিলাতী দ্রব্য জোর করে বয়কট করলে দেশের দরিদ্র মানুষেরই সবচেয়ে ক্ষতি হবে। কিন্তু নিখিলের প্রতিবাদ সন্দীপের বেপরোয়া চরম দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। সন্দীপের এই বেপরোয়া দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ক্রমশ খারাপ পথে নিয়ে যেতে  থাকে। সে তার বন্ধু নিখিলের স্ত্রীর সঙ্গেই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। একজন মুসলিম মাঝি যখন তার উপার্জন বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় স্বদেশিদের নির্দেশ উপেক্ষা করে তার নৌকায় বিলাতী পণ্য পরিবহন অব্যহত রাখে তখন সন্দীপ সেই দরিদ্র মুসলিম মাঝিটির নৌকা জলে ডুবিয়ে দিতে তার একজন অনুগামীকে নিদের্শ দেয়। সন্দীপ তার অনুগামীদের মুসলিম-বিদ্বেষী করে তোলে এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে উদ্দীপ্ত করে। আর নিখিল এই দাঙ্গা প্রশমিত করতে গিয়ে দাঙ্গাতেই তার মৃত্যু হয়। বেপরোয়া সন্দীপের কর্মকা- এবং আদর্শবাদী ও মানবিক নিখিলের চরিত্রের মাধ্যমে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি রবীন্দ্রনাথ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আন্দোলনের নামে কীভাবে নৈতিকতার মৃত্যু ঘটছে তা নিখিলের মৃত্যুতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসে চিত্রিত নিখিলের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাঙ্গালী উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রকাশ করে। সন্দীপের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে নিখিলের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তৎকালীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাখ্যানের  বিষয়টিকেই প্রকাশ করে। স্বদেশি আন্দোলন পরিচালনার পন্থায় তাঁর মোহভঙ্গের বিষয়টি শুধু সাহিত্যে নয়, জাপান ও ব্রিটেনে ১৯১৬-১৭ সালে প্রদত্ত তাঁর বেশ কিছু বক্তৃতায়ও তাঁর এই মোহভঙ্গের বিষয়টি উঠে এসেছে।
রবীন্দ্রনাথ আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে সমকালীন সময়ে বিদ্রুপের শিকার হলেও পরবর্তীকালের ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর রাজনৈতিক পন্থাই সর্বাধিক ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে তাঁর চিন্তিত অহিংস ও অসহযোগ পন্থাই ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলনের পন্থা হিসাবে গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ও পরিচালনায় অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন সারা দেশের আন্দোলনে তীব্র জোয়ার আনে। স্বদেশি আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের পন্থাই গান্ধীজী তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনে সর্বাধিক  প্রয়োগ করেছেন।  তাই রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থাকে গান্থীজী তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পূর্বসূরী বরে অভিহিত করা যেতে পারে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়বাদী ও সহাবস্থানের মহান আদর্শ প্রতিটি দেশে, প্রতিটি যুগেই অনুকরণীয় হতে পারে। বর্তমান উন্মত্ত ও হিংসা-বিধ্বস্ত পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক আন্দোলনের পন্থা, দৃষ্টিভঙ্গি ও আদর্শ আরও বেশি করে প্রয়োজনীয় ও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 




সূত্র নির্দেশ ঃ
১। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্র জীবনকথা’।
২। Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis: Tapati Dasgupta
৩। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কালান্তর’।
৪। Selected letters of Rabindranath Tagore: Edited by Krishna Dutta, Andrwe Robinson
৫। Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
৬। http:/ww/w.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html : Uma Das Gupta, Anandarup Ray
৭। http:/ww/w.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh


General References:

1| cÖfvZKzgvi gy‡Lvcva¨vq, Ôiex›`ª RxebK_vÕ|
2| Social thought of Rabindranath Tagore - A Historical Analysis: Tapati Dasgupta
3| iex›`ªbv_ VvKz‡ii ÔKvjvšÍiÕ|
4| Selected letters of Rabindranath Tagore: Edited by Krishna Dutta, Andrew Robinson
5| Autobiography of an Unknown Indian, Part II: Nirad C. Chaudhuri
6| http://www.parabaas.com/rabindranath/articles/pContemporaryTagore.html : Uma Das Gupta, Anandarup Ray
7| http://www.homeandlocalfood.org.uk/061012TagoreVillageandWorld.doc : Christine Marsh